আজকাল অনেক মুসলিমই প্রকৃত বিষয়টি না জেনে নানা রকম বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করে থাকে। তারা কেবল তাদের সাংস্কৃতিক নেতাদের মতোই এসব ক্ষেত্রে অন্ধ অনুসারী। তারা এটি খুবই কম উপলব্ধি করে যে, তারা যা নির্দোষ বিনোদন হিসেবে করে তার শিকড় আসলে পৌত্তলিকতায়, যা তারা লালন করে তা কুসংস্কার থেকেই জন্ম। এমনকি ইসলাম যা পোষণ করে এসব তার প্রত্যাখ্যান। ভালোবাসা দিবস আমেরিকা ও ব্রিটেন বাদে গোটা ইউরোপে মৃত হলেও হঠাৎ করেই তা মুসলিম দেশগুলোয় আবার প্রবেশ করছে। কিন্তু কার ভালোবাসা? কেন এ দিবস পালিত হবে?
অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে তারা যেমন করে, এ বিষয়েও কথিত আছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে উর্বরতা ও পশুর দেবতা বলে খ্যাত লুপারকাসের (Lupercus) সম্মানে পৌত্তলিক রীতিনীতির একটি অংশ হিসেবে রোমনারা ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন শুরু করে। এর মূল আকর্ষণ হলো পরবর্তী বছরের লটারির আগ পর্যন্ত বর্তমান বছরে লটারির মাধ্যমে যুবকদের মাঝে যুবতীদের বন্টন করে দেয়া। এ দিন উদযাপনে অন্যান্য ঘৃণ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে এটি ছিল, এক টুকরো ছাগরের চামড়ায় আবৃত যুবতীদের দু’জন যুবক কর্তৃক উৎসর্গকৃত ছাগল ও কুকুরের রক্তে ভেজা চাবুক দিয়ে প্রহার করা। মনে করা হতো ‘পবিত্র যুবক’দের প্রতিটি ‘পবিত্র’ আঘাত দ্বারা ওই সব যুবতী ভালোভাবে সন্তান ধারণে সক্ষম হবে।
খ্রিস্টান সম্প্রদায় যথারীতি লুপারকালিয়ার (Lupercalia) এ ঘৃণ্য রীতিকে বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করল। প্রথমে তারা মেয়েদের নামে লটারির বদলে ধর্মযাকদের নামে লটারির ব্যবস্থা চালু করল। এর উদ্দেশ্য হলো, যে যুবকের নাম লটারিতে উঠবে সে যেন পরবর্তী একটি বছর যাজকের মতো পবিত্র হতে পারে। কিন্তু খ্রিস্টানরা খুব কম স্থানেই এ কাজে সফল হলো।
একটি জনপ্রিয় খারাপ কাজকে কিছু পরিবর্তন করে তাকে ভালো কাজে লাগানোর প্রবণতা বহু পুরনো। তাই খ্রিস্টানরা শুধু লুপারকালিয়া থেকে এ উৎসবের নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন করতে পারল। পোপ গ্যালাসিয়াস (Gellasius) ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে এটি করল। তথাপি খ্রিস্টান কিংবদন্তিতে ৫০-এরও বেশি বিভিন্ন রকম ভ্যালেন্টাইন আছে। এদের মধ্যে মাত্র দু’জন সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যদিও তাদের জীবন ও চরিত্র এখনো রহস্যাবৃত। একটি কিংবদন্তি হলো, যেটি বেশি প্রকৃত ভ্যালেন্টাইন হলেন ‘প্রেমিকদের যাজক’- যে নিজেকে কারাগারের প্রধানের মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু কিচু মারাত্মক অসুবিধার জন্য ফ্রান্স সরকার উল্লিখিত লটারি ১৭৭৬ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কাল পরিক্রমায় এটি ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানি থেকেও উঠে যায়। এর আগে সপ্তদশ শতাব্দীতে পিউরিটানরা যখন শক্তিশালী ছিল যে সময় ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় চার্লস এটি ১৬৬০ সালে পুনরুজ্জীবিত করেন। ইংল্যান্ড থেকেই এটি নতুন বিশ্বে আগমন করে যেখানে এটিকেই টাকা বানানোর ভালো মাধ্যম হিসেবে নিতে ইয়াংকিরা (আমেরিকানরা) উদ্যোগী হয়। ১৮৪০ সালের দিকে ইস্টার এ হল্যান্ড হোয়াট ‘এলস ভ্যালেন্টাইন’ (What else Valentine) নামে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে আমেরিকান ভ্যালেন্টাইন যে কার্ড বানায় এবং প্রথম বছরই ৫০০০ ডলারের কার্ড বিক্রি হয় (তখন ৫০০০ ডলার অনেক)। সে থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে ফুলে ফেপে ওঠে।
এটি হ্যালোইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ ভূত এবং অপদেবতার মতো পোশাকে সজ্জিত হয়ে পৌত্তলিকদের একটি প্রাচীন শয়তান পূজার পুনঃপ্রচলন করে। পৌত্তলিকেরা এর নাম দেয় সামহাইন (Samhain) যা সোয়েন (Sowen) হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমনটি ভ্যালেন্টাইন ডে’র ক্ষেত্রে ঘটেছিল। খ্রিস্টানরা এর নাম পরিবর্তন করে ঠিকই, কিন্তু পৌত্তলিক শিকড় পরিবর্তন করতে পারেনি। দৃশ্যত নির্দোষ অনুষ্ঠানেরও পৌত্তলিক শিকড় থাকতে পারে। পূর্বকালে মানুষ ভূতপ্রেতকে ভয় পেত, বিশেষভাবে তাদের জন্মদিনে। একটি প্রচরিত বিশ্বাস ছিল, মন্দ প্রেরণা একজন ব্যক্তির জন্য অধিক বিপজ্জনক যখন কেই প্রাত্যহিক জীবনে একটি পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যেমন জন্মদিনে বা একটি বছরের শুরুতে। কাজেই সে ব্যক্তির পরিবার ও চার পাশের বন্ধুবান্ধব হাসি-আনন্দের মাধ্যমে জন্মদিনে তাকে মন্দ থেকে রক্ষা করত, যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়।
কী করে একজন সচেতন মানুষ ভাবতে পারে ইসলাম অনৈসলামিক ধারণা এবং বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত অযৌক্তিক আচার অনূষ্ঠানের ব্যাপারে উদাসীন থাকবে?
এটি একটি বিশাল ট্র্যাজেডি যে মিডিয়ার মাধ্যমে নিত্য বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক অপপ্রচারে মুসলমানেরা ভালোবাসা দিবস (Valentine Day) হেলোইন (Halloween) এবং এমনকি (Santaclaus) সান্তাক্লজকেও আলিঙ্গন করে নেয়” (ইম্প্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল, লন্ডন, মার্চ ২০০১)
এ দিনটিকে যদি ভালোবাসা দিবস হিসেবেই পালন করতে হবে তবে ভালোবাসা দিবসের ইংরেজী হওয়া উচিত ছিল ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লাভার্স ফেস্টিভাল ডে’। অথচ আমরা যাকে ভালোবাসা দিবস বলে উদযাপন করছি, একটি দিন ও রাতকে প্রেম সরোবরে ডুব দেয়া, সাতার কাটা, চরিত্রের নৈতিক ভূষণ খুলে প্রেম সরোবরের সলিলে হারিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাাচ্ছি সেটার উৎপত্তিগত নাম ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ (Saint Valentine’s Day) এর প্রথম শব্দটিই এ দিনটির আসল পরিচয়ের জানান দিতে যথেষ্ট। Advanced Oxford Learners’ Dictionary শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে- A Person Declared to be holy by the christian church because of her/his Qualities or good works. অর্থাৎ এমন ব্যক্তি, খ্রিস্টান গীর্জা কর্তৃক যাকে তার গুণাবলী বা ভালো কাজের জন্য পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষনা করা হয়। …………… অর্থ ভালোবাসা নয় বরং এক ব্যক্তির নাম। সুতরাং সহজেই বুঝা যায়, গীর্জা কর্তৃক ‘পবিত্র সত্তা’ হিসেবে ঘোষিত হওয়া একজন ধর্মযাজকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন-ই এ দিনটি উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য।
ভ্যালেন্টাইন ডে সম্পর্কে যে ইতিহাস পাওয়া যায় তা অতি প্রাচীন। বর্তমান সময়ে পালিত এ দিবসের উৎস প্রায় ১৭শ বছর আগের পৌত্তলিক (অগ্নি উপাসক) রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালোবাসা’ উৎসব থেকে। রোমানরা পরবর্তীহে খ্রিস্টধর্ম ধারণ করলেও তাদের প্রাচীন উৎসব ছাড়তে পারেনি বরং সে উৎসবের ভিন্নতা এনেছে মাত্র। এ ঘটনার পেছনে যে ইতিহাস ও কল্পকাহিনী পাওয়া যায় তার সংখ্যা অনেক। তবে ঐতিহাসিকরা যে সূত্রটির ওপর নির্ভর করেছেন সেটি হচ্ছে- রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস এর শাসনামলে ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক-সদালাপী এবং খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক ছিলেন। অপরদিকে রোম সম্রাট ছিলেন দেব-দেবীর আরাধনায় বিশ্বাসী। স¤্রাটের তরফ থেকে ভ্যালেন্টাইন্সকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। ফলে, ভ্যালেন্টাইন্সকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্রাট ভ্যালেন্টাইন্সকে মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে হত্যা করেন। উল্লেখ্য যে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স কারারুদ্ধ থাকার সময় প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীরা প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। জনৈক কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ে ভ্যালেন্টাইন্সের সাথে দেখা করত এবং দীর্ঘক্ষণ গল্প করত। একসময় ভ্যালেন্টাইন্স মেয়েটির প্রেমে মজে। ভ্যালেন্টাইন্সের ফাসি হওয়ার পূর্বে মেয়েটির কাছে যে পত্র লিখে যায় তার শিরোনাম ছিল ‘লাভ ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন্স’। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যে রোম শহর তথা ইতালিতে বর্তমানের কথিত ভালোবাসা দিবসের জন্ম সেই ইত্যালিতে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ ছিল।[DR.KHALILUR RAHMAN.13 FEBRUARY-2016]