ইসলামে নারী অধিকার : নারী উন্নয়ন নীতি
ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান
প্রাথমিক কথা ঃ
ইসলামী জীবন বিধানই নারী ও পুরুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। দিয়েছে নারীদের জান-মালের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান।
জাহিলী যুগে যেখানে মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো, নারীদের হাটে-বাজারে পশুর মতো বিক্রি করা হতো, দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো; কন্যা সন্তানের জন্মের সংবাদে পিতা মাতার চেহারা বিমর্ষ হতো। সেখানে মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদ এ তাদের সমালোচনা করে বলেছেন:
আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। (সূরা নাহল: আয়াত ৫৮)। নারী সমাজের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে মহানবী (সা) বলেছেন: “মেয়ে শিশু বারকাত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক”। তিনি আরো বলেন: “যে তিনটি, দু’টি বা একটিও কন্যা সন্তান যথাযথভাবে লালন পালন করবে সে জান্নাতী”। (বুখারী শরীফ) “আল¬াহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা ঘোষনা করে বিশেষ মর্যাদা দান করেন।” (সূরা ইসরাঃ আয়াত ৭০) “তিনি মানবজাতিকে নারী ও পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত করে সৃষ্টি করে তাদেরকে পরস্পরের সহযোগী করেছেন। যে নারী বা পুরুষ সর্বাধিক ধর্মপরায়ণ আল¬াহ তাকে সর্বাধিক মর্যাদাবান।” (সূরা হুজরাতঃ আয়াত ১৩)
মহান আল্ল¬াহ পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করেছেন মানবজাতির উপর। নারী ও পুরুষ উভয়ে মিলে এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যকার অধিকার ও সুযোগ-সুবিধায় কিছুটা তারতম্য হওয়াই স্বাভাবিক। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উন্নতি না হলে ব্যক্তি, সংসার ও সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এই লক্ষ্যে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রনয়ণের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, সেই নীতিমালা যেন নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দাঁড় না করায়। তা যেন সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় আকিদা বিশ্বাস, সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। মানুষের মধ্যে কার কি অধিকার তা কুরআন-সুন্নাহতে বলে দেয়া হয়েছে। ন্যায্য পাওনা ও অধিকারের বিষয়ে কুরআন মজীদ ও সুন্নাহর নির্দেশনা ও বিধান সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এমন কি নারী উন্নয়ন নীতি’১১ এ কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বহু ধারা বলবৎ রেখে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে “নারী-নীতিতে’১১” ইসলাম ও কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কিছু নেই বলে গোটা জাতির সাথে প্রতারনা করছে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, একজন নারী ও একজন পুরুষের সমন্বয়ে। মানব ভুমিষ্টের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ এবং একজন নারীর ভূমিকা প্রায় সমান এক্ষেত্রে নারীর অবদান বরং বেশীই বলা যায়। মা গর্ভান্তরে লুকিয়ে রাখে তার অনাগত সন্তানটি দশ মাসের অধিক সময় পর্য । এক সময় জীবনের শংকা নিয়ে ভূমিষ্ট করেন একটি নবজাতক শিশু। এখানেই সমাপ্তি নয় প্রায় আড়াই বছর পর্যন্ত অবলা নারী তার শিশু সন্তানটিকে স্বযতেœ দায়িত্বের সাথে দুধপান করিয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ঘোষনা করা হয়েছে “আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ প্রদান করছি। (কেননা সন্তান ভূমিষ্টের ক্ষেত্রে) তার মা বহু কষ্টে তাকে গর্ভে ধারন করে এবং তাকে ভূমিষ্টও করে বহু কষ্টের সাথে”। (সুরা আহযাব, আয়াত-১৫) সন্তান ভুমিষ্ট ছাড়াও নারীরা সমাজের বহু গুরুত্বপূর্ন কাজে অবদান রাখছে। সাংসারিক জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সর্বাঙ্গনে নারীদের ভূমিকা অসামান্য। দেশ ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রেও নারীদেরও অবদান উল্লেখ করার মত।
কিন্তু বর্তমান এ সভ্য সমাজের কতিপয় মানবরুপি প্রাণী, হায়েনার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঐ সুন্দর অবলা নারীদের উপর বিভিন্ন ভাবে চড়াও হচ্ছে। যে মায়ের জাতি প্রতিনিয়ত তাদের কর্মকান্ড দ্বারা এ পৃথিবীটাকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, যাদের পদচারণা না হলে সমাজিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যেত সেই জাতিকে লাঞ্চিত করে উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করা হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের ও গোষ্টির লোকেরা নারীর উপর অমানবিক আচরন করেছে। হিন্দু ধর্মে নারীকে লক্ষীনি, পদ্মীনি, রাক্ষসী, অপেয়া বিভিন্ন ভৎসনার নামে সীমাহীন হেয় করেছে এবং সতীদাহ প্রথা চালু করে নারী জাতির চিরস্বাধীনতা হরণ করেছে। ইহুদী ও খৃষ্টবাদে নারীর কোন অধিকারই ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- “ইংরেজ নারীরা ১৮০৭ইং, জার্মান নারীরা ১৯০০ইং, সুইস নারীরা ১৯০৭ইং, এবং অষ্ট্রেলীয় নারীরা ১৯১৯ইং সালের আগ পর্যন্ত কোন প্রকার সম্পদের অধিকারী হতে পারতো না। {আব্দুল কারিম বিআজার সিরাজী, নারী নির্যাতন যুুগে যুগে (ঢাকাঃ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতি কেন্দ্র, ডিসেম্বর-১৯৯২ইং) পৃঃ৫}
বর্তমান সময়ের চেয়ে প্রাচীনকালের মানুষেরা কন্যা সন্তান অপেক্ষা পুত্র সন্তানকে অগ্রাধিকার দিতো বেশী। কিন্তু মহানবী (সা) বললেন: “তোমাদের কারো যদি কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তান থাকে আর সে যদি তাদের জন্য কোন কিছু নিয়ে আসে তবে প্রথমে তা মেয়ের হাতে দিবে এবং মেয়ে বেছে নিয়ে তার পর তার ভাইকে দিবে”। (সুনান)
স্ত্রীদের গুরুত্ব সম্বন্ধে মানবতার মুক্তির দুত রাসূল (সা) বলেছেন: “উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক”। (মুসলিম:২:১১২) স্ত্রীদের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি আরো বলেন: “তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।” (তিরমিযী শরীফ)
বিধবাদের অধিকার সম্বন্ধে বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন:. “যারা বিধবাদের দায়িত্ব নেয় তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজী ও সদা রোজা পালনকারী।” (বুখারী, মুসলিম)
কুরআন কারীমে “নারী” নামে নারীর অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র বৃহৎ সূরাও নাযিল হয়েছে (سورة النساء)। যা পুরুষের বেলায় এভাবে হয়নি। এ জন্য জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন: “একমাত্র হযরত মুহাম্মাদই (সা) নারীদের যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন।”
নারীর ন্যায্য অধিকার: ইসলামের স্থায়ী নীতি
যখন কোন মানব সমাজে নারীদের কোন কিছুর অধিকার ছিল না তখন আল্লাহ তায়ালা সেই ভ্রান্তির অপনোদন করে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষনা দিলেন “নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের।” (সূরা বাকারা, আয়াত-২২৮)
ইসলাম পূর্ব যুগে নারীর ওপর যে অত্যাচার-অবিচার চলত তার প্রতিবাদ করে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- “তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত জীবনযাপন করবে।” (সূরা নিসা, আয়াত-১৯)
পূর্বেই বলা হয়েছে, কোন জাতিই নারীর কোন কিছুর ওপর নিজস্ব অধিকার থাকাকে স্বীকার করত না। ইসলাম এসে নারী জাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালার বাণী- “পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ।” (সূরা নিসা, আয়াত-৩২) জাহেলীযুগে মানুষ সম্পদশালিনী নারীদের বিয়ে করত তাদের সম্পদের লোভে। ঐ নারীদের স্বামী মারা গেলে তখনকার লোকেরা ঐ ব্যক্তির মাল-সম্পদের ন্যায় তাদের বিধবা স্ত্রীকেও জবরদস্তিভাবে নিজেদের ওয়ারিশ বলে গণ্য করত। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েও করে বসত, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ জারি করলেন- “হে ঈমানদারগণ, নারীদেরকে জবরদস্তি করে উত্তরাধিকার গণ্য করা তোমাদের জন্য হালাল নয়।” (সূরা নিসা, আয়াত-১৯) নারীদেরকে যখন তাদের পাওনা মোহরানা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে বন্দী করে রাখা হত, তখন আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করেন- “তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছে তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করার উদ্দেশে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখ না”। (সূরা নিসা, আয়াত-১৯) মানুষ ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে মনে করত নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র পুরুষের সেবা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করলেন- “তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ”। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৭) অর্থাৎ এই জীবনে একজন আরেকজনের পরিপূরক। পুরুষরা আর একটি বিয়ে করার দূরভিসন্ধি নিয়ে নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচার বা এ ধরনের কোন অভিযোগ খাড়া করত, যাতে সেই স্ত্রী স্বেচ্ছায় নিজস্ব সম্পদ ও প্রাপ্য ত্যাগ করেই চলে যায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করলেন- “তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহন করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছুই গ্রহন করো না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপাচার দ্বারা তা গ্রহন করবে।” (সূরা নিসা, আয়াত-২০) পিতামাতার সম্পত্তিতেও ইসলাম নারীর অধিকার লিপিবদ্ধ করেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- “পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে।” (সুরা নিসা, আয়াত-৭)
নবী (সঃ) বিদায় হজ্জে বলেছেন:- “সাবধান! তোমাদের নারীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমন অধিকার রয়েছে। {তিরমিযী, তিনি এ হাদিসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন, রিয়াদুস সালেহীন ১/২৭৬ নং}
নারীর সম্পদের উৎস সমূহঃ
ইসলাম পূর্ব যুগে নারীগণ সম্পদের মালিক হওয়া দুরের কথা নিজেরাই ছিলো ভোগের পন্য। ইসলাম সম্পদে নারীদের ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। নারীদের সম্পদের মালিকানা বিষয়ে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের নির্ধারিত বিনিময় (মহর) দিয়ে দাও”। আরো বলা হয়েছে: অর্থাৎ- পুরুষগণ তার মালিক হবে যা তারা অর্জন করবে আর নারীগণ তার মালিক হবে যা তারা অর্জন করবে”। (সুরা নিসা)। রমনীদের সম্পদের প্রদান উৎস তিনটিঃ ১) মহর। (স্বামীর কাছ থেকে বিবাহের সময় এককালিন প্রাপ্ত অর্থ) ২) পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, স্বামী ও সন্তানের উত্তরাধিকার। ৩) নিজ অর্জিত সম্পদ। *উল্লেখিত আয়ের উৎসসমূহ থাকা সত্বেও তাদের ব্যয়ের কোন খাত নেই, এমন কী তার নিজ ভরণ-পোষনও তার নিজের দায়িত্বে নেই। যেমনঃ বিবাহের পূর্বে তার সকল দায়িত্ব পিতার উপর, বিয়ের পর স্বামীর উপর এবং বার্ধক্যে সন্তানের উপর।
ইসলামে পুরুষের প্রাধান্য কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে?
এ প্রসঙ্গে কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: পুরুষগণ নারীদের দায়িত্বশীল, এজন্য যে, (সৃষ্টিগতভাবে) আল্লাহ একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, আর এজন্য যে, তারা (পুরুষেরা) ব্যয় করে (নারীদের মহর প্রদান ও ভরণ পোষনের জন্য)”। উক্ত আয়াতে কারীমায় নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্বের দু’টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছঃ প্রথম কারণটি প্রাকৃতিক বা সৃষ্টিগত, আর দ্বিতীয় কারণটি সামাজিক বা অর্জিত। আমরা সামান্য মনোনিবেশ করলে দেখতে পাবো আসলে নারী-পুরুষ কখনো সমান নয়। সৃষ্টিগতভাবেই তাদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। যেমনঃ নারী-পুরুষের গতি প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস-রুচি, শখ ও পছন্দ ইত্যাদি এক নয়। তদুপরি ওজন ও উচ্চতা, নাড়ী, রক্তচাপ, হরমোন ও মস্তিস্কে রয়েছে প্রচুর পার্থক্য।
তথাকথিত সাম্যবাদীগণ বলে থাকেন “সৃষ্টিগতভাবে নারী-পুরুষ সমান; কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে বৈষম্যের কারনে নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে”। এ নেহায়েত কান্ডজ্ঞাণহীন বেকুবের মত বক্তব্য বৈ কিছু নয়। এখানে আমরা বলবো ‘প্রকৃতিতে মানুষ ছাড়াও যেসব প্রাণী রয়েছে তারা নারী শাসিত বা নারী প্রধান পরিবারে ও সমাজে বাস করা সত্বেও তাদের মধ্যে নারী-পুরুষের পার্থক্য সুস্পষ্ট কেন? যেমনঃ সিংহের কেশর আছে, সিংহীর নেই; বাঘের গোফ আছে, বাঘিনীর নেই; মোরগের মাথায় ঝুটি আছে, মুরগীর নেই; হাঁসার লেজে বক্র পালক আছে, হাঁসীর নেই; ষাড়ের স্কন্ধ মেধ আছে, গাভীর নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ঃ
যেহেতু নারী ও পুরুষের সৃষ্টিগতভাবে সমান নয় তাই তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কর্মক্ষেত্রেও এক নয়।
যেমন পুরুষ পৌরুষ সুলভ সৌর্য-বীর্য নিয়ে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে এবং উপার্জন করবে আর নারী রমনী সূলভ কোমলতা নিয়ে পরম øেহ ও মমতায় সংসার বা পরিবারে দায়িত্ব পালন করবে, সন্তান ধারণ ও লালন পালন করবে। তার বিপরীতে পুরুষের পক্ষে যেমন সন্তান ধারন সম্ভবপর নয় তেমনি নারীর পক্ষেও প্রতিরক্ষাসহ কঠিন কাজগুলো করা সহজ সাধ্য নয়। সুতরাং নারী পুরুষের সমান অধিকার নয় বলতে হবে ন্যায্য অধিকার বা সুষম অধিকার, অর্থাৎ ইকুয়্যালিটি নয় বরং ইকুইটি বা ন্যায় বিচার। দায়িত্ব অনুপাতে অধিকার লাভ হয়, অধিকার সমান করতে হলে দায়িত্ব সমবন্টন করতে হবে, আর তা হবে বাস্তবে প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও অবৈজ্ঞানিক।
ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, তাই ইসলামের বিধানসমূহ প্রকৃতির অনুকুল। আর ইসলামের বিরোধিতা মানে প্রকৃতির সাথে বিরুপ আচরণ করা। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করলে সভ্যতা ধ্বংশ হয়। সংগত কারণে মুসলিম সমাজে এবং মানব সভ্যতায় মেয়ে অপেক্ষা ছেলের দায়-দায়িত্ব বেশী। যেহেতু নারী পুরুষ উভয়ের কর্মক্ষেত্র ও দায়িত্বেও পরিধি সমান নয় তাই উভয়ের মধ্যে সম্পদও সমবন্টন ন্যায়সঙ্গত নয়। যে কারণে ইসলাম উত্তরাধিকারে ছেলেকে বেশী দেওয়ার কথা বলেছে। সে কারণগুলো হচ্ছে: ১) বংশ রক্ষা করা। ২) আত্মীয় স্বজনের তত্ত্বাবধান করা। ৩) পারিবারিক সামাজিক দায়িত্ব পালন করা। ৪) স্ত্রীর মহর প্রদান ও ভরণ পোষনের দায়িত্ব পালন করা। ৫) সন্তানের ভরণ পোষন ও লালন-পালনের ব্যয়ভার বহন ও ৬) বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখা শুনা ও সেবা শুশ্রুষা করা।
উল্লেখ্য যে, একজন পুরুষের তিনটি ফরজ খরচের খাত রয়েছে, যা নারীদের নেই। যথাঃ ১) সাবালক হওয়ার পর থেকে নিজের ভরণ পোষন, ২) বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণ পোষণ ও ৩) সন্তান হলে তাদের ভরণ পোষন। তাই ১৯৪৭ এর পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানে এবং ১৯৭১ এর পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশে মুসলিম উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এই আইন বলবৎ রয়েছে। ভারত সরকারও মুসলমানদের উত্তরাধিকার আইনে হস্তক্ষেপ করেনি। এমনকি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী আইন পাঠ্যভূক্ত। সুতরাং বাংলাদেশেও শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে নয় বরং কোন ধর্মের বিরুদ্ধেই কোন আইন বা নীতিমালা করা সঙ্গত নয়।
“নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১” শুধু ইসলাম বিরোধী নয় বরং হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্মসহ সকল ধর্ম বিরুধী।
অনুরুপ জাতি সংঘের নারী উন্নয়ন সনদ ‘সিডও’ সকল ধর্ম বিরোধী। যার কারণে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশ এতে স্বাক্ষর করলেও তা বাস্তবায়ন করছে না। “সিডও” হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত আন্তর্জাতিক নারী নীতি। ঈঊউঅড এর পূর্নরূপ হচ্ছে:-
ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ ধষষ ঋড়ৎসং ড়ভ উরংপৎরসরহধঃরড়হ অমধরহংঃ ডড়সবহ (ঈঊউঅড) শীর্ষক আন্তর্জাতিক সনদ এর অনেক ধারা মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির বিরুধী। জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহ কর্তৃক যে সকল আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো প্রণীত হয় পাশ্চাত্যের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভংগীর আলোকে। এর সাথে অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভংগীর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই তাদের প্রণীত যে কোন নীতিমালা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে গভীরভাবে বিশে¬ষণ না করে গ্রহণ বা বর্জন করা যাবে না। কারণ মুসলমানগণ কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কোন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে না।
উক্ত ঈঊউঅড এর ২, ৩, ৯, ১৩, ১৬ নং ধারা সহ আন্তর্জাতিক নীতি সমূহ সুস্পষ্টভাবে কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলাম বিরোধী অনেক ধারা রয়েছে যেমন-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার, কুমারী গর্ভপাত বৈধ করা, সমকামিতা বৈধ করা ইত্যাদি। অতএব ঈঊউঅড বাস্তবায়ন অর্থই হলো কুরআনী আইনকে কবর দেয়ার শামিল। তাই দেখা যায় মুসলিম দেশগুলি এবং অনেক অমুসলিম দেশ ও “সিডও” সনদ তাদের সামাজিক মূল্যবোধের সাথে অসংগতি বিধায় উক্ত ধারা সমূহে আপত্তি জানিয়েছে।
মহান আল্ল¬াহ তায়ালা বলেন: “আল্ল¬াহ ও তাঁর রাসূল (সা:) কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে সেই বিষয়ে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা কোন মুমিন নারীর ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকবে না। কেহ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট হবে।” (সূরা আহযাব, আয়াত ৩৬) বাংলাদেশের বিগত সরকারসমূহ এই সনদের আপত্তিকর ধারাসমূহের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আপত্তি যোগসহ তাতে স্বাক্ষর করলেও ৯২% মুসলমানের এ দেশে কেউ ইহা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এক্ষেত্রে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানব সভ্যতায় পুরুষরাই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এমনকি তথাকথিত উন্নত বিশ্ব ইউরোপ আমেরিকাতেও এবং ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠিতেও পুরুষরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কারণ এটাই স্বাভাবিক। আজও আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মতো দেশে প্রায় ৮০% নারী গৃহিনী, সম্প্রতি শান্তির অন্বেষনে অতি আধুনিকরাও ইসলামিক পরিবার প্রথার দিকে ঝুকছেন। ইসলাম রমনীদের যতটুকু অধিকার ও সুবিধা দিয়েছে এযাবত তা পূর্ণরুপে বাস্তবায়ন হয়নি। তাই নারীদের উন্নয়নের জন্য ইসলাম প্রদত্ত অধিকার বাস্তবায়ন করা হোক এবং সে অনুযায়ী নীতিমালা করা হোক।
কেন ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ গ্রহণযোগ্য নয়?
১। কোন দেশের আইন বা নীতিমালা তৈরী হয় সে দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া-জলবায়ু, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় চেতনার উপর ভিত্তি করে। তাই ইউরোপ আমেরিকার জন্য যে নীতিমালা প্রযোজ্য বা উন্নয়নে সহায়ক মনে করা হবে তা আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত মনে করার কোন কারণ নেই।
২। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় চেতনা এবং প্রচলিত আইন নারী উন্নয়নে তথা জাতীয় উন্নয়নে যথেষ্ট সহায়ক। প্রয়োজনে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরো নীতিমালা তৈরী করা যেতে পারে।
৩। উন্নয়নের উদ্দেশ্য কি? আমরা জানি উন্নয়নের উদ্দেশ্য হলো সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে সুখ-শান্তি লাভ করা।
অধুনা আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের জরিপ রিপোর্টে দেখা গেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি সুখি দেশ হলো দরিদ্র এশিয়ার মুসলিম ১০টি দেশ যার মধ্যে উন্নয়নশীল বাংলাদেশও রয়েছে। আর পৃথিবীর নিকৃষ্ট দশটি অসুখী দেশ হলো তথাকথিত উন্নত বিশ্ব ইউরোপ আমেরিকার সেরা ধনী ১০টি দেশ। সমান অধিকারের দেশ আমেরিকার মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ড. আইওনি ব্রিস্টো এর ভাষ্যমতে “আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় আট লাখ নারী ধর্ষিতা হন, ৭০% স্বামী স্ত্রীকে প্রহার করে, ৬৫% স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সন্তানসহ তাড়িয়ে দেয়।” এ সকল দৃষ্টান্ত থেকে আমরা বুঝতে উন্নয়ন সমৃদ্ধি আর সুখ শান্তি এক নয়। আর যে উন্নয়নে সুখ শান্তির পরিবর্তে অশান্তি বৃদ্ধি হয় সে উন্নয়ন কোন বুদ্ধিমান লোকদের কাম্য হতে পারে না।
নারী উন্নয়ন মানে কি?
তথাকথিত উন্নত বিশ্বে যেখানে সন্তান তার মাতৃ পিতৃ পরিচয় বঞ্চিত, যুব সমাজ অন্য একটি মেয়ে/নারীকে দায়িত্ব নেয়ার ভয়ে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চায় না, বরং শয্যাসঙ্গী করে অহরহ, বৃদ্ধ পিতা মাতা সন্তানের কাছ থেকে পান অবহেলা, তাদের ভাবাদর্শে কেন আমরা উন্নয়ন নীতি তৈরী করবো।
একমাত্র ইসলামই নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে:
ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে এবং সমাজে তার যৌক্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে ও তার অবদানের অকুন্ঠ স্বীকৃতি প্রদান করেছে। সাথে সাথে করেছে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর বিপরীতে যারা অধার্মিক তারা নারীকে ভোগ্যপন্য ও বিলাসিতার বস্তুতে পরিণত করার অপচেষ্টা করছে।
কেমন হওয়া উচিৎ উন্নয়ন নীতি ঃ
মানুষ সামাজিক জীব, অন্য দিকে প্রকৃতির অংশ। তাই মানুষকে জীবনধারণ, বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয় বিধানই মেনে চলতে হবে। প্রাকৃতিক বিধান লঙ্ঘন করলে ধ্বংশ অনিবার্য আর সামাজিক বিধান ভঙ্গ করলে নেমে আসে বিপর্যয়।
সামাজিক নিয়মগুলো প্রকৃতি হতে মানুষের লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে উঠে। সামাজিক বিধানসমূহের মধ্যে ধর্মীয় বিধানই শ্রেয়। যেখানে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সন্তান বাবা অপেক্ষা মাকে বেশী শ্রদ্ধা করে, বেশী অনুগত থাকে, যেখানে স্বামীরা স্ত্রীর জন্য ভালোবাসার তাজমহল রচনা করে, যেখানে ভাইয়েরা বোনের ইজ্জত-আব্র“ ও আব্দার রক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়, যেখানে বাবারা কন্যাসন্তানের প্রতি সহানুভুতিশীল হয় সেখানে উন্নয়ন নীতি হবে প্রবাহমান সামাজিক মূল্যবোধ ও বিদ্যমান ধর্মীয় চেতনাকে শানিত করে। এবং সাম্যের বিধান ইসলাম নারীকে যে ন্যায্য অধিকার দিয়েছে তা যথাযথভাবে আইনে রুপদান করে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা।
নারীর প্রতি অবমাননাকর জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর সর্বনাশা দিকসমূহ:-
এ বিষয়টি বর্তমানে দিবালোকের মতো পরিস্কার যে, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হলোঃ
১। সুকৌশলে ইসলামের উপর আঘাত করা।
২। মুসলিম জাতিকে অনৈসলামী সমাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।
৩। যুবসমাজকে বিবাহে নিরুৎসাহিত করে ব্যভিচার ও পাপাচারের পথে ঠেলে দেয়া।
৪। ইসলামী মূল্যবোধকে ভূলুষ্ঠিত করা।
৫। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি যা দেশীয় ভাবধারায় লালিত এবং ইসলামী মতাদর্শে পরিশীলিত তা বিনষ্ট করে সমাজে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো।
৬। আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ধ্বংস করে পরাশ্রয়ী করে তোলা।
৭। সর্বোপরি বর্তমান সরকারকে জনগণের মুখোমুখি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।
ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধ হেফাজতে আমাদের দাবী:-
আমাদের জাতিসত্বার সাথে সামঞ্জস্যশীল, সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও ধর্মীয় চেতনা নির্ভর “নারী উন্নয়ন নীতি” তৈরী করত তা জাতীয় সংসদে অনুমোদন করা।
এখানে নিম্মোক্ত তিনটি বিষয় বিচেনাযোগ্য ১) আইয়ুব খান কর্তৃক প্রবর্তিত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ বাংলাদেশ সরকার ও আদালত মানতে বাধ্য কিনা? ২) প্রয়োজনে কুখ্যাত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ সংশোধন করা যায় কিনা? ৩) বর্তমান প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কোন ধারা বা উপ-ধারা ইসলামী আইনের পরিপন্থি হলে কোনটি সংশোধন করতে হবে, কুরআন নাকি আইন ও সংবিধান?
প্রথমত: খান কর্তৃক প্রবর্তিত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ বাংলাদেশ সরকার ও আদালত মানতে বাধ্য নয়; কারণ বাংলাদেশ ইসলামী আইন মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত: আইয়ূব খান প্রবর্তিত বিতর্কিত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ সরকার যে কোন সময় উলামায়ে কিরামের সহযোগিতায় সংশোধন করতে পারে।
তৃতীয়ত: দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কোন ধারা যদি ইসলামী আইনের বিরোধী হয় তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে তা কুরআনের আলোকে সংশোধন করতে হবে।
নির্ঘন্টঃ ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ কুরআন কারীমের যে সকল আয়াতের সাথে ও বাংলাদেশের সংবিধানের যে সকল ধারার সাথে সাংঘর্ষিক। আল কুরআন : সূরা নিসা আয়াত- ৪, ২৩, ২৪, ২৫, ও ৩৪। সূরা তালাক আয়াত-১, ৪, ৬ ও ৭। সূরা বাকারা আয়াত-২২৮ ও ২৮২। সূরা আহযাব আয়াত- ৩৩ এবং ৪ঃ১, ২ঃ১৮৭ ও ২২৩, ২২ঃ৫. ২৩ঃ১২ ও ১৪, ১৩ঃ২৬, ১৭ঃ৩০, ২৮ঃ৮২, ২৯ঃ৬২, ৩০ঃ২৭, ৩৪ঃ৩৬, ৩৯ঃ৫২, ৪২ঃ১৩। বাংলাদেশের সংবিধান ধারা ২ (ক), ৩৯, ৪১ (১) (ক), দন্ড বিধি ধারা ২৯৮।
“জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এ”?
ইয়াহুদী-খ্রিস্টান ও মুশরিক-নাস্তিকদের মদদপুষ্ট এবং ইউরোপ-আমেরিকার ভাবধারায় পরিচালিত কিছু ‘এনজিও’ কর্তৃক তৈরীকৃত, বর্তমান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ সম্পর্কে সরকারের পক্ষে কেউ কেউ বলছেন ‘এতে ইসলাম ও কুরআন বিরোধী কিছু নেই।’ যেহেতু সরকার এ ব্যাপারে সংশোধনের নামে চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে প্রতারনা করেছে, তাই জাতির সামনে “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১” এ বিদ্যামান ইসলাম ও কুরআন বিরোধী বিষয়াবলী এখানে উল্লেখ করা হলো। যাতে করে ইসলাম, কুরআন ও ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হয়।
* উল্লেখ্য যে, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ এ ধারা ও উপ-ধারা ছিল সর্বসাকুল্যে ১২৭২টি, তন্মধ্যে ইসলাম-কুরআন ও বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী ধারা ছিল মোট ৫৯টি। যা উলামায়ে কেরাম ও জনগণের প্রতিবাদের মুখে সংশোধনে সম্মত হয়ে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করেছিল তৎকালিন কেয়ারটেকার সরকার। কিন্তু বর্তমানে অনুমোদিত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০১’ তে ইসলাম-কুরআন ও বাংলাদেশ সংবিধান বিরোধী ধারা আছে ৯৩টি। তন্মধ্যে ৩৭টি ধারা রয়েছে ইসলাম-কুরআন ও বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী। ২৯টি ধারা রয়েছে সরাসরি ইসলাম ও কুরআন বিরোধী। ২৬টি ধারা রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী। ১টি ধারা রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত সকল রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সরকারসমুহের চিন্তা ও আদর্শ বিরুদ্ধ এবং ইসলাম বিরোধী।
** ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০১’ এ ধারা (৪৯) উপ-ধারা (১৫৬), বর্ণ-ধারা (৭) ও বন্ধনী (১০) সর্বসাকুল্যে রয়েছে ২২২টি। তন্মধ্যে কুরআন, ইসলাম ও বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী রয়েছে ৯৩টি বিষয়।
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০১’ এ বিদ্যমান ইসলাম-কুরআন ও সংবিধান পরিপন্থী ধারাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হলোঃ
১) ১ এ বলা হয়েছেঃ সকল ক্ষেত্রে নারীর সমসুযোগ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
২) নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা।
৩) ২ এ বলা হয়েছেঃ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোড়ামী, কুপমন্ডুকতা ও বৈষম্যের বেড়াজাল মুক্ত করা।
৪) নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।
৫) ৪ এ বলা হয়েছেঃ নারী দশকের লক্ষ ছিল সমতা।
৬) ক্ষমতা বন্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মাঝে তীব্র অসমতা বিদ্যামান। এই অসমতা ও সীমাবদ্ধতা নিরসনের উদ্দেশ্যে সরকার সমূহকে উদ্যোগ নিতে তাকিদ দেয়া হয়।
৭) সকল আন্তর্জাতিক ঘোষনা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গিকারাবদ্ধ।
৮) সকল সনদ ও কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর এবং এগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গিকার করেছে।
৯) ৪ এ বলা হয়েছেঃ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) নারী অধিকার সংরক্ষনে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদন্ড বলে বিবেচিত।
১০) ৮ এ বলা হয়েছেঃ ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও ফতোয়ার ঘটনা ঘটছে।
১১) ১০ এ বলা হয়েছেঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৬০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষিত।
১২) ১৫ এ বলা হয়েছেঃ আন্তর্জাতিক সনদসমূহ যথা সিডও, সিআরপি, বেইজিং ঘোষনা ও কর্মপরিকল্পনার আলোকে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
১৩) নারীর ক্ষমতায়ন।
১৪) ১৬.১ এ বলা হয়েছেঃ রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৫) ১৬.৩ এ বলা হয়েছেঃ নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও আইনগত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।
১৬) ১৬.৫ এ বলা হয়েছেঃ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারায় নারীর পূর্ণ অংশ গ্রহন নিশ্চিত করা।
১৭) ১৬.৮ এ বলা হয়েছেঃ নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা।
১৮) ১৬.১২ এ বলা হয়েছেঃ রাজনীতি প্রশাসন ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া এবং পারিবারিক জীবনের সর্বত্র নারী পুরুষের সমানধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৯) ১৬.১৩ এ বলা হয়েছেঃ নারীর স্বার্থের অনুকুল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আমদানী করা এবং নারীর স্বার্থ বিরোধী প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
২০) ১৬.১৫ এ বলা হয়েছেঃ আশ্রয় ও গৃহায়ন ব্যবস্থায় নারীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা।
২১) ১৬.১৯ এ বলা হয়েছেঃ গণমাধ্যমে জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা।
২২) ১৬.২২ এ বলা হয়েছেঃ নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করা।
২৩) ১৭.১ এ বলা হয়েছেঃ মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার সকল ক্ষেত্রে, যেমন ঃ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ যে সমঅধিকার, তার স্বীকৃতি স্বরুপ নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ করা।
২৪) ১৭.২ এ বলা হয়েছেঃ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (ঈঊউঅড) এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা।
২৫) ১৭.৫ এ বলা হয়েছেঃ স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরুপ কোন কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
২৬) ১৭.৬ এ বলা হয়েছেঃ বৈষম্যমুলক কোন আইন প্রণয়ন না করা বা বৈষম্যমুলক কোন সামাজিক প্রথার উম্মেষ ঘটতে না দেয়া।
২৭) ১৮.১ এ বলা হয়েছেঃ বাল্য বিবাহ, কন্যা শিশু ধর্ষন, নিপিড়ন পাচারের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করা।
২৮) ১৮.৪ এ বলা হয়েছেঃ কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমুলক আচরণ দুরীকরণ এবং পরিবারসহ সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা।
২৯) ১৯.৫ এ বলা হয়েছেঃ পুলিশ বাহিনীর সর্বস্তরের বর্ধিতহারে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৩০) ১৯.৬ এ বলা হয়েছেঃ বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে নারীর সংশ্লিষ্ট আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া ও জেন্ডার সংবেনশীল করা।
৩১) ২০.৩ এ বলা হয়েছেঃ আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশনে নারী প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্ত করা।
৩২) ২১.১ এ বলা হয়েছেঃ নারী শিক্ষা, নারী পুরুসের মধ্যে শিক্ষার হার ও সুযোগের বৈষম্য দুর করা এবং উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসরণ করা।
৩৩) ২২.১ এ বলা হয়েছেঃ ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারীর বর্ধিত অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা।
৩৪) ২২.২ এ বলা হয়েছেঃ স্থানীয় পর্যায়ে নারীর জন্য পৃথক ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়ে তোলা।
৩৫) ২২.৩ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহন নিশ্চিত করা।
৩৬) ২২.৪ এ বলা হয়েছেঃ নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে নারীকে উৎসাহিত করার লক্ষে সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা করা।
৩৭) ২৩ এ বলা হয়েছেঃ জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকান্ডে নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিত করণ।
৩৮) ২৩.৫ এ বলা হয়েছেঃ সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশিদারিত্ব দেয়া।
৩৯) ২৪ এ বলা হয়েছেঃ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন।
৪০) ২৫.১ এ বলা হয়েছেঃ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পুর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।
৪১) ২৬.১ এ বলা হয়েছেঃ নারীর শ্রমশক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্যে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ।
৪২) ২৬.২ এ বলা হয়েছেঃ চাকরী ক্ষেত্রে নারীর বর্তিত নিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষে প্রবেশ পর্যায়সহ সকল ক্ষেত্রে কোটা বৃদ্ধি এবং কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
৪৩) ২৬.৩ এ বলা হয়েছেঃ সকল নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুসৃত কোটা ও কর্মসংস্থান নীতির আওতায় চাকরী ক্ষেত্রে নারীকে সকর প্রকার সুযোগ প্রদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
৪৪) ২৬.৪ এ বলা হয়েছেঃ নারী উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে তোলা।
৪৫) ২৬.৫ এ বলা হয়েছেঃ নারীর বর্ধিতহারে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, অবস্থান ও অগ্রসরমানতা বজায় রাখার লক্ষে প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে তোলা।
৪৬) ২৬.৬ এ বলা হয়েছেঃ নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষে সংশ্লিষ্ট সকল আইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা।
৪৭) ২৭ এ বলা হয়েছেঃ জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট ও জেন্ডার বিভাজিত ডাটাবেইজ প্রণয়ন।
৪৮) ২৭.১ এ বলা হয়েছেঃ নারী উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
৪৯) ২৭.২ এ বলা হয়েছেঃ জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা এবং রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রক্রিয়া অনুসরণ অব্যাহত রাখা।
৫০) ২৮ এ বলা হয়েছেঃ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহন।
৫১) ২৯.১ এ বলা হয়েছেঃ নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, আমদানী ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা।
৫২) ২৯.৩ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর স্বার্থের অনুকুল লক্ষ্য সমূহ অর্জনের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংস্কার করা।
নারী অধিকারের বিষয়টি ১/১১ এর পর তত্ত্ববাধায়ক সরকারের আমলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় (পলিসি লিডারশীপ এন্ড এ্যাডভোকেসি ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’ প্রকল্পের সহযোগিতায়) জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮’ অনুমোদন করে। প্রকাশের পর উলামা মাশায়েখগণের পক্ষ থেকে এর কঠোর প্রতিবাদ করা হয়, দেশব্যাপী সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভের ঝড় উঠে। একে কেন্দ্র করে নানা মুখী বিতর্কের সুত্রপাত হয়েছে। পরে আলেম-উলামাগণের বাধার মুখে তা স্থগিত রাখা হয়।
উক্ত বিতর্কিত নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ আংশিক পরিবর্তন করে “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১” নামে মন্ত্রিপরিষদে খসড়া অনুমোদন করে। প্রকৃত পক্ষে এটি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ এরই প্রতিচ্ছায়া। এতে কিছু শব্দের পরিবর্তন ছাড়া মূলত কোন পরিবর্তনই করা হয়নি। তাই উপরোক্ত বিষয় দু’টির গুরুত্ব অনুধাবন করে উলামায়ে কিরাম ও আপামর মুসলিম জনসাধারণ এর তীব্র প্রতিবাদ করছেন। এক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১তে কুরআন ও ইসলাম বিরোধী কিছু নেই। এতে উলামা-মাশায়েখগণ বিভ্রান্ত না হলেও তারা ছল-চাতুরির মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রতারনা করে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে তারা যেন মুসলমানদের সাথে প্রতারণার লুকোচুরি খেলছেন। একদিকে সরকারের নির্বাচনী ইস্তিহারে বলেছেন ইসলাম বিরোধী কোন আইন করা হবে না।
উক্ত নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ এর আলোচ্য ধারাসমূহে সমঅধিকার, সমান অধিকার ইত্যাদি বলে সরাসরি কুরআনের বিধান পরিবর্তনের দুঃসাহস দেখানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার বাণী: “ন্যায়সংগতভাবে নারীদের আছে পুরুষদের উপর তেমন অধিকার যেমনটি আছে তাদের উপর পুরুষদের অধিকার। তবে নারীদের উপর পুরুষদের মর্যাদা আছে এক ধাপ বেশী। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারা, আয়াত ২২৮) “একজন পুরুষ একজন নারীর দ্বিগুন সম্পদ পাবে।” (সূরা নিসা: আয়াত:১১ ও ১৭৬) এ ছাড়াও পবিত্র কুরআন মজীদের সূরা নিসা আয়াত- ৪, ২৩, ২৪, ২৫, ও ৩৪। সূরা তালাক আয়াত-১, ৪, ৬ ও ৭। সূরা বাকারা আয়াত-২২৮ ও ২৮২। সূরা আহযাব আয়াত- ৩৩ এবং ৪ঃ১, ২ঃ১৮৭ ও ২২৩, ২২ঃ৫. ২৩ঃ১২ ও ১৪, ১৩ঃ২৬, ১৭ঃ৩০, ২৮ঃ৮২, ২৯ঃ৬২, ৩০ঃ২৭, ৩৪ঃ৩৬, ৩৯ঃ৫২, ৪২ঃ১৩ আয়াত সমূহের সাথে সু-সস্পষ্ট সাংঘর্ষিক। ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে মাতা, ভগ্নী ও কন্যা হিসেবে সম্মানিত করেছে। সমঅধিকার নয় বরং তাদের ন্যায্য অধিকার দিয়ে সামগ্রিকভাবে নারীদেরকে হেফাজত করা হয়েছে।
“বিদ্যমান সকল বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করা” এর কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিধানের লংঘন। আল-কুরআন প্রদত্ত ওয়ারিসী স্বত্ব আইন (আল কুরআন, সূরা নেসা, আয়াত: ১১,১২,১৭৬) ও বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন (আল-কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৮-২৩২, ২৩৬-২৩৭, ২৪১ ও সুরা তালাক, আয়াত: ১-২, ৪, ৬) বাংলাদেশে বিদ্যমান ও কার্যকর আইনের অন্তর্ভূক্ত। উল্লেখিত দুই বিষয় তথা মিরাস ও তালাকের ক্ষেত্রে তারা নারীর প্রতি বৈষম্য মনে করলেও আসলে তা নয়। তা আল্লাহ তায়ালার মহাপ্রজ্ঞা বিধান এবং নারীর জন্য কল্যাণকর। তাঁর এই প্রজ্ঞাকে আমাদের অনুধাবন করতে হবে। অতএব “বৈষম্যমূলক আইন” বিলোপ করার কথা বলে সরাসরি কুরআনের আয়াত বিলোপের কথা বলা হয়েছে।
আশ্রয়, গৃহায়ন ও ভরন পোষনের ক্ষেত্রে কুরআনের স্পষ্ট বিধানই রয়েছে। সেখানে “অগ্রাধিকারের” কথা বলে কুরআনী আইন লংঘিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বাণী: নারীদের ভরন-পোষনের ব্যবস্থা করে ধনীরা তাদের সামর্থ অনুযায়ী এবং গরিবরা তাদের সামর্থ অনুযায়ী, ন্যায্যভাবেই এ ব্যবস্থা করতে হবে।” (সুরা বাকারা, আয়াত ২৩৬)
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০কে ধর্মহীন, ইসলাম বিমুখ শিক্ষানীতি হওয়ার কারণে উলামা-মাশায়েখ, পীর, বুদ্ধিজীবি মহল তা প্রত্যাখান করেছে।
মহিলাদের চলচিত্র ও সিনেমা নির্মাণে নারীকে সরকারী সহায়তার নামে দেশকে অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা নারীদের জন্য ঘোষনা করেন: “আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবো এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্ল¬াহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্ল¬াহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” (সূরা আহযাব : আয়াত ৩৩)
উপসংহার
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে যুগে যুগে সকল ধর্মের মানুুষেরা নারীদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। কেবল মাত্র ইসলামই নারীকে মাতা, ভগ্নি, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সঠিকভাবে মুল্যায়ন করেছে এবং নারী জাতির মর্যাদা সংরক্ষণ করেছে। নারীর এ নিশ্চিত অধিকার আদায়ের জন্য এবং সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একমাত্র ইসলামী বিধানেই সঠিক নির্দেশনা পাওয়া যায়।
তথাকথিত মানবতাবাদী ও নারীবাদীদের প্রতি আমাদের আহ্বান “আসুন আমরা ইসলাম নারীকে কি অধিকার দিয়েছে তা জানি এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে তা বাস্তবায়নে প্রয়াসী হই। নারীর প্রকৃত স্বার্থের অনুকুলে ইসলামের আলোকে নীতিমালা ও যথাযথ আইন প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নে সরকারসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করি এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন করি। মহান আল্লাহ সকলের কল্যাণ করুন। আমীন॥