ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক
ড.মুহাম্মাদ খলীলুর রহমান মাদানী
ওরা মানুষ নয়, ওরা শ্রমিক!পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ডজন ডজন খুন করো,মালিকদের খুশী করতে গ্রেফতার করো যত পারো।যত, বেশি কাজ করানো যাবে, মালিক অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণি তত বেশি মুনাফা পাবে।শ্রমিকদের বোবা কান্না দেখার সময় আমাদের নেই। সুন্দর এ পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতায় শ্রমিকদের কৃতিত্ব বেমালুম ভূলে যাও। আক্ষেপ নয়! সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণীকে সর্বদাই উপেক্ষা, অবহেলা ও সুবিধাবঞ্চিত না করলে আয়েশে থাকা যাবে না!। উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে সারাদিন খাটে যে শ্রমিক,সচল রাখে তার মালিকের অর্থযন্ত্রটি, সেই মালিকেরই অবিচারে শ্রমিকদের অচল জীবনটি আরো দুর্বিষহ করতেই হবে। মৌমাছির মত যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে একফোঁটা মধুও জোটে না!জমিদারী, বাহাদুরী ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়ার জন্য শ্রমিকের পেটে যত জোরে লাথি মারতে পারো! বড় বড় জোঁক সেঁজে শ্রমিকের রক্ত যত পারো শোষণ করো!প্রতিবাদ করলে ছাঁটাই করো,শোষণের মাত্রা বাড়াও।ভিক্ষুকের ঝুলিতে কমিশন নাও,রিক্সাশ্রমিকদের জন্য ১০০০০টাকর রিক্সা দিয়ে মালিক তুমি বছরে শোষণ করো ৫০০০০ টাকা।চাঁদাবাজরা ও শ্রমিকদের পিছু ছাড়বে না- সকল শ্রমিকের সামান্য টাকার বকরা বসাও- নইলে ধাক্কা দিয়ে বস্তি বা খুপড়ি ঘর থেকে রাস্তায় লাথি মেরে উল্টে দাও।-(বিবেকের দংশন থেকে লেখা, কেউ মনে কষ্ট পাবেন না প্লিজ)
ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ এক আদমের সন্তান। পেশা, বর্ণ বা অঞ্চলের ভিত্তিতে মানুষের মাঝে কোনোরূপ বিভাজন হতে পারে না। মানবতার মুক্তির একমাত্র দ্বীন বা জীবন ব্যাবস্থা হলো ইসলাম সব মানুষের বিশেষ করে শ্রমিকদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং বস্তুগত কোন মানদণ্ড দিয়ে এ সম্মানের তুলনা চলে না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে শ্রমিকের হাতে চুমু খেতেন। তিনি আনসারির হাতে চুমু খেয়ে বললেন, “এই হাতে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৫৬৭)তিনি বলেছেন, ‘দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি বকরী চরাননি।।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.), আপনিও কি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমিও এক ‘কিরাত’ (সামান্য অর্থ) দু’কিরাত -এর বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছি- ((ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড পৃ. ৩০৯)।শ্রমের মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে রাসূলুল্ল¬াহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ- ‘কারো জন্য স্বহস্তের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আর আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ করতেন’। বুখারী, মিশকাত হা/২৭৫৯।
*একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবী হ’ল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أُعْطُوا الْأَجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَّجِفَّ عَرقُهُ- ‘তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’। ২২. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৯৮৭, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।
১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস এর প্রেক্ষাপট:-ইসলামী শিক্ষা ভূলে গিয়ে- একটি সময় ছিল যখন শ্রমিকদের দিয়ে দিনে ১৫/১৬ ঘণ্টা এমনকি ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হতো, কাজের কোনো নির্দিষ্ট সীমা ছিলো না। যত, বেশি কাজ করানো যাবে, মালিক অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণি তত বেশি মুনাফা অর্জিত হবে।শ্রমিকদের বোবা কান্না দেখে কে? প্রথম অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ পেতো যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে ফেলা বা বিক্ষিপ্তভাবে মারপিটের ঘটনার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে শিখল। ট্রেড ইউনিয়ন জন্ম নিল। সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন দানাবাঁধতে শুরু করলো। ১৮৬৬ সালের ২০ আগস্ট ন্যাশনাল ইউনিয়নের প্রথম সম্মেলনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৮৬৬ সালে এপ্রিল-মে নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হয়। ১, ৩ ও ৪ মে ধর্মঘট ও সমাবেশ হয়। শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে শ্রমিক সমাবেশে মালিক শ্রেণীর গুন্ডা বাহিনী ও পুলিশ আক্রমণ করে। তাতে ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয়েছিলেন অনেকে। পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ৭ জন নেতাকে গ্রেফতার করে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তারা হলেন আগস্ট স্পাইজ, স্যামুয়েল ফিলডেন, মাইকেল স্কোয়ব, জর্জএঙ্গেল, এডলপ ফিশার, লুই লীঙ্গ, অস্কার নীবেও এলবার্ট পার্সন। বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন। স্পাইজ, ফিশার, এঙ্গেল ও পার্সনকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফিলডেন ও স্কোয়ারের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। অন্যদের ১৫ বছরের কারাদ- হয়। লীঙ্গ কারাগারে নিহত হয়। ১৮৮৭-এর ১১ নভেম্বর ফাঁসির দিন ঘোষিত হয়। স্পাইজ, ফিশার, এঙ্গেল ও পার্সন ফাঁসির মঞ্চে নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন।
পরবর্তীতে শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতাকারী মালিকপক্ষের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জুরি’ গঠন করে ১৮৮৬ সালের ২১ জুন শুরু করা হয় বিচারের নামে প্রহসন। একতরফা বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর ঘোষিত হয় বিচারের রায়। রায়ে বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে শ্রমিক নেতা পার্সন্স, ফিলডেন, স্পাইজ, লুইস, স্কোয়ার, এঞ্জেল ও ফিশারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয় এবং ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর সে আদেশ কার্যকর করা হয়। শ্রমিক নেতা ও কর্মী হত্যার এ দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১লা মে ‘শ্রমিক হত্যা দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কার্য সময় ও সপ্তাহে এক দিন সাধারণ ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করে প্রথম শ্রম আইন প্রণীত হয়। অন্যদিকে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ গোটা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকারে এনে দেয় নতুন গতি। শিকাগো শহরে সৃষ্ট এ আন্দোলন ক্রমশ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। পৃথিবীর সকল শ্রমজীবী মানুষ এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানটি। সেই সাথে ১২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া সে ঘটনাটির কথা তখন থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয়ে থাকে ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’ হিসাবে।
শ্রমিকদের পাশাপাশি নানা শ্রেণী-পেশার লোকজন মে দিবসের শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। অথচ যে দেশের শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে আজকের দিনটি শ্রমিক দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে, সে দেশে কিন্তু ১লা মে শ্রমিক দিবস পালিত হয় না। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস পালন করা হয়।
ইসলামই শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করেছে
শ্রমিকদের হাতে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষমতা না থাকায় নিজেদের গতরে খেটে পেট চালাতে হয়। এই ভেবে তাদের মানসিক কাঠামো দুর্বল থাকে। এক লজ্জাজনক অনুভূতির শিকার তারা।তাই ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের ওপর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় শ্রমনীতি প্রণয়ণ করেছে। কেননা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই যেকোনো সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।আল্লাহ তায়ালার কাছে মালিক শ্রমিক, উঁচু-নীচু, আমীর-গরিব, বাদশাহ্-ফকির সবাই সমান, যার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পূর্ববর্তী সব নবী ও রাসুল এবং আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সা.) একজন শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লভ্যাংশের অংশীদার হয়ে হজরত খাদিজার (রা.) ব্যবসায় শ্রম দিয়েছেন। তাই আমরা ইসলামী সমাজব্যবস্থায় দেখি, একজন শ্রমিক বা মজুরও রাষ্ট্রীয় কর্ণধার হতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি মদিনার গভর্নর হয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখি রাসুল (সা.)-এর বংশধর হজরত জয়নুল-আবেদীন নিজের এক দাস শ্রমিককে স্বাধীন করে দিয়ে ঔরসজাত কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তারা (অধীন ব্যক্তিরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, সে তার ভাইকে যেন তা-ই খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়, তাকে তা পরিধান করতে দিবে, যা সে পরিধান করে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত, তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সেই কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে’- (বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৮৯৪) ।
ইসলামী সমাজে একদিকে যেমন মালিক-শ্রমিকের শ্রেণীবিভাগ বা উদ্ভূত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবকাশ নেই; তেমনি পারস্পরিক স্বার্থোদ্ধারের বিভেদমুক্ত থেকে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভ্রাতৃসুলভ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক ছাঁটাই ও গুজব রটিয়ে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ইস্যু তৈরি ইত্যাদি অনভিপ্রেত অবস্থার উদ্ভব হতে দেখা যায়। বস্তুত এসব বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে মালিকের প্রধান কর্তব্য হলো কর্মদক্ষ, সুদক্ষ শক্তি-সামর্থ্যবান, আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কাজে নিয়োজিত করা এবং সময়, কার্যকাল ও ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করে শ্রমিককে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ করা। শ্রমিকের বেতন-ভাতা যতক্ষণ পর্যন্ত স্থির করা না হবে এবং সন্তুষ্টচিত্তে সে তা গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে জোর করে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজে নিযুক্ত করা ইসলাম সম্মত নয়। ইসলাম শিক্ষা দেয়, শ্রমিক-মজুর আপনার-আমার মতো রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। তাদেরও অনুভূতি আছে, আছে মান-মর্যাদাসমেত স্বাভাবিক জীবনকাল নির্বাহ করার। তারাও নিজ পরিশ্রমে ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করতে পারে। ইসলামের এই মৌলিক সত্যটির দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহপাক বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই বেশি মর্যাদাবান, যে অধিক পরহেজগার’- (৪৯:১৩)।দেখতে পাই, একজন সৎকর্মশীল ও পরহেজগার শ্রমজীবী মানুষ একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির থেকে বহুগুণ উঁচুস্তরের। পেশায় শ্রমিক-মজুর বলে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা নেই। কেননা ইসলাম তার মর্যাদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষণ করেছে।
সত্যি কথা বলতে কী, শ্রম ইতিহাসে ইসলামই প্রথম শ্রমিকের প্রতি যথার্থ দৃষ্টি দিয়েছে। তাকে দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদা আর শ্রমের স্বীকৃতি।পক্ষান্তরে কোনো কোনো সনাতন ধর্মে শ্রমের অর্থ ছিল দাসত্ব ও বশ্যতা। আবার কোনো ধর্মে এর অর্থ ছিল লাঞ্ছনা ও অবমাননা।
আর ইসলাম শ্রমিকের যে মর্যাদা প্রদান করেছে, পৃথিবীর যেকোনো ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। পৃথিবিতে সর্বপ্রথম মহানবী (সা.)-ই ঘোষণা করেছেন- ‘শ্রম-মেহনত পড়ে থাকা জিনিস নয়’। তিনি বলেছেন, ‘দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি বকরী চরাননি।।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.), আপনিও কি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমিও কয়েক ‘কিরাত’ (সামান্য অর্থ)-এর বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছি- ((ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড পৃ. ৩০৯)।যুগে যুগে প্রত্যেক নবীই নিজ নিজ শ্রমলব্ধ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ বিন্দুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয়। বরং এ হচ্ছে নবীগণের সুন্নাত । ‘মুসতাদরাকে হাকিম’ গ্রন্থে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আদম (আ.) কৃষক ছিলেন। হযরত নুহ (আ.) কাঠ মিস্ত্রি ছিলেন। হযরত দাউদ (আ.) কর্মকার ছিলেন। হযরত ইদ্রীস (আ.) দর্জি ছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) রাজমিস্ত্রি ছিলেন। হযরত ইসমাঈল (আ.) রাজমিস্ত্রির যোগাড়ী ছিলেন। হযরত মুছা (আ.) ছাগলের রাখাল ছিলেন।হজরত দাউদ (আ.) বর্ম তৈরি করতেন। হজরত আদম (আ.) কৃষি কাজ করতেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। হজরত ইদরীস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং হজরত মূসা (আ.) রাখালের কাজ করতেন- (ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড পৃ. ৩০৬)। সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা যেমন শ্রমদানে অভ্যস্ত ছিলেন, তেমনি অন্যদেরও শ্রমদানের প্রতি উৎসাহিত করতেন। নবী দুলালী ফাতেমা (রা.) পানি টানতে গিয়ে বুকেপিঠে দাগ পড়ে যেত, যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোসকা পড়ে যেত, তবুও তিনি শ্রম-বিমুখ হননি। এমনকি মানবসেবার মূর্ত প্রতীক মহানবী (সা.) খন্দক যুদ্ধের প্রাক্কালে নিজ হাতে পরিখা (দূর্গ) খনন কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের মহান পেশাকে সম্মানিত করেছেন।(যাদুল মা’য়াদ/২/১২৬) এই মৌলিক সত্যটির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের মধ্যে তারাই বেশি মর্যাদাবান যারা তাকওয়ার অধিকারী। রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, অনারবী ব্যক্তির উপর আরবের, কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের বা শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন প্রাধান্য নেই। (যাদুল মায়াদ)।
তিনি আরো বলেছেন, ” চাকর, দাস-দাসী ও ‘অধীনদের সঙ্গে অসদাচরণকারী বেহেশতে যেতে পারবে না’- (তিরমিজি:২৩৯৮)।
নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সৎ উপার্জনশীল হয়! (মুসনাদে আহমদ:৩৪৫৯) একবার রসুল (সা.)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কোন উপার্জন শ্রেষ্ঠতম? তিনি উত্তরে বলেন, নিজেরে শ্রমলব্ধ উপার্জন ((ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড পৃ. ৩০৬)। রসুল সা. আরো বলেন, যে ব্যক্তি নিজের শ্রমের উপর জীবিকা নির্বাহ করে, তার উপর উত্তম আহার আর কেউ করে না। জেনে রাখো, আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ.) নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জনে জীবিকা চালাতেন। (বুখারী-মিশকাত:২/১৩৮), কুরআন হাদিসের আলোকে শ্রমিকের অধিকার * তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খেতে দাও যা তুমি নিজে খাও। তাকে তাই পরিধান করতে দাও যা তুমি নিজে পরিধান করো। (বুখারী আবু হুরায়রা (রা.)। * ক্ষমতার বলে অধীনস্ত চাকর বাকর দাস দাসীদের প্রতি খারাপ আচরণকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, অধীনস্তদের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ইবনে মাযাহ * আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, কেউ তার অধীনস্তকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের বিচারের দিন তার থেকে বদলা নেয়া হবে। তাবরানী। * হযরত উমার (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি যৌবনকালে শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন, বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি দিতে পারে না। (ইবনে মাযাহ: ২/১৪৬)। * দাস দাসীদের ভাল ব্যবহার সৌভাগ্য আর তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার দুর্ভাগ্য। * মজুরকে তার কাজ হতে অংশদান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না। মুসনাদে আহমদ। * তোমাদের খাদেম যদি তোমাদের খাদ্য প্রস্তুত করে এবং তা নিয়ে যদি তোমাদের কাছে আসে যা রান্না করার সময় আগুনের তাপ দেয় ও ধোঁয়া তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে তখন তাকে খাওয়াবে। খানাপিনা অল্প হলেও তার হাতেও এক মুঠো দু’মুঠো তুলে দিবে। (মুসলিম, হাদীস নং ১৫৬৭)
সংক্ষেপে কতিপয় মৌলিক শ্রম অধিকার তুলে ধরা হলো :
* শ্রমের মজুরি প্রাপ্তির অধিকার :
পবিত্র কুরআনে দেড়শ স্থানে ‘আজর’ তথা শ্রমের মূল্য বা বিনিময় শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে। সবগুলোই কর্মজীবনে পারস্পরিক বিনিময়ের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এদিকে অধিকাংশ অর্থে তা বিবৃত হয়েছে পার্থিব জীবনের নানা পর্বে-অনুষঙ্গে এবং তার স্বল্পদৈর্ঘ স্থায়ীত্ব বিষয়ে। কর্মজীবনের নানা বিনিময়ের অর্থে এর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত কুরআন ও হাদীসে ব্যাপকহারে বিদ্যমান। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
বল, ‘আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনি, বরং তা তোমাদেরই। আমার প্রতিদান তো কেবল আল্লাহর নিকট এবং তিনি সব কিছুর উপরই সাক্ষী। {সূরা সাবা’, আয়াত : ৪৭}
আরেক জায়গায় শু‘আইব ও মূসা আলাইহিমাস সালামের ঘটনার বর্ণনায় ইরশাদ করেন,
‘অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন লাজুকভাবে হেঁটে তার কাছে এসে বলল যে, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, আমাদের পশুগুলোকে আপনি যে পানি পান করিয়েছেন তার বিনিময়ে’। {সূরা আল-কাসাস, আয়াত : ২৫}
এই দুই দৃষ্টান্তে ‘আজর’ বা প্রতিদান শব্দটি আমাদের মাঝে প্রচলিত কষ্ট বা শ্রমের বিনিময় কিংবা সেবার মূল্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করি পবিত্র কুরআনে আমলের সঙ্গে সঙ্গে আজর বা প্রতিদানের কথাও বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‘তবে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিদান’। {সূরা আত-তীন, আয়াত : ৬}
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমগ্রে নজর দিলেও আমরা আমলের সঙ্গে আজর তথা কর্মের সঙ্গে প্রতিদানের কথা পাশাপাশি দেখতে পাই। এসব শব্দের সবগুলোই দুনিয়া ও আখেরাতের প্রতিদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থবোধক। “ইবন হাযম রহিমাহুল্লাহ বলেন, যে আয়াতগুলোয় আমল ও আজর তথা প্রতিদানের কথা উল্লিখিত হয়েছে সবগুলোই শুধু ধর্মীয় কাজের সঙ্গে বিশিষ্ট নয়, বরং তা যে কোনো ধরনের কাজ-কর্মের ব্যাপক ও বিস্তৃত একটি নিয়ম। চাই তা দুনিয়াবী কাজ হোক অথবা আখেরাতের আমল হোক।”
* চুক্তিকালে শ্রমগ্রহীতা যার শর্ত করেছিলেন শ্রমিকের সেসব প্রাপ্তির অধিকার : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তিসমূহ পূর্ণ কর”। {সূরা আল-মায়িদাহ: ১}
হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“ধনী ব্যক্তির (পক্ষ থেকে কারও পাওনা প্রদানে) টাল-বাহানা করা জুলুম; আর যখন তোমাদেরকে কোনো আদায় করতে সক্ষম ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত করা হয়, তখন সে যেন তার অনুসরণ করে”[ বুখারী, হাদীস নং ২২৮৭; মুসলিম, হাদীস নং ১৫৬৪।
]।
*অপর হাদীসে এসেছে,
“মহান আল্লাহ বলেন, তিনজন আমি তাদের বিপক্ষে থাকব কিয়ামতের দিন, তন্মধ্যে একজন হচ্ছেন, যাকে আমার জন্য প্রদান করার পর সে তার সাথে গাদ্দারী করেছে, আর একজন হচ্ছেন, যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার অর্থ খেয়েছে। আর একজন হচ্ছে সে ব্যক্তি যে কাউকে কর্মচারী নিয়োগ করার পর তার থেকে তার কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ সে তাকে তার প্রাপ্য দেয় নি।”[বুখারী, হাদীস নং ২২২৭।]
অপর হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“শ্রমিককে তার শ্রমের প্রাপ্য তার ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই প্রদান কর”[মুসলিম : ৬৭৩৭।]।
* শ্রমিকের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা কাজে অক্ষম বানানোর মতো কাজে বাধ্য না করার অধিকার :
মূসা আলাইহিস সালামকে নিজ সম্পদের তত্ত্বাবধানের কাজ বুঝিয়ে দেবার সময় যেমন আল্লাহর ‘নেক বান্দা’ বলেছিলেন,
‘আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তুমি ইনশাআল্লাহ আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত পাবে’। {সূরা আল-কিসাস, আয়াত : ২৭}
শ্রমগ্রহীতা যখন তার প্রতি এমন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন যা তাকে বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয় এবং যার ফলে পরবর্তীতে তার স্বাস্থ্য বা ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তবে তার অধিকার রয়েছে চুক্তি বাতিল কিংবা বিষয়টি দায়িত্বশীলদের কাছে উত্থাপন করার। যাতে করে তারা তার ওপর থেকে শ্রম গ্রহীতার অনিষ্ট রোধ করেন।
* উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেলেও শ্রমিকের কাজ চালিয়ে যাবার বা নিজ কর্মে বহাল থাকার অধিকার :
সাধারণ নিময় হলো, শ্রমগ্রহীতা যখন কোনো যুবকের সঙ্গে কাজের চু্ক্তিতে আবদ্ধ হন আর সে তার কাজে নিজের যৌবন কাটিয়ে দেয়। অতপর বার্ধক্য হেতু তার কর্মোদ্যমে অবসন্নতা বোধ করে তাহলে শ্রমগ্রহীতা তাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করতে পারেন না। বরং তার করণীয় হলো,শ্রমিকের বুড়োকালের উৎপাদনেও তেমনি সন্তুষ্ট হওয়া যেমন সন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি তার যৌবন ও সামর্থ্যকালে।
* শ্রমিকের আত্মসম্মান রক্ষার অধিকার :
তাকে কোনো অবমাননা বা লাঞ্ছনাকর কিংবা দাসসুলভ কাজে খাটানো যাবে না। ইসলাম এবং ইসলামের মহান ব্যক্তিদের জীবনে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও ব্যক্তিতে সমানাধিকারের মূলনীতিকে সমর্থন করে।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমিক ও কাজের লোকের সঙ্গে আহার গ্রহণ করতেন। তার কাজের বোঝা লাঘবে সরাসরি সহযোগিতা করতেন। তেমনি শ্রমিককে প্রহার বা তার ওপর সীমালঙ্ঘনেরও অনুমতি নেই। যদি তাকে প্রহার করে তবে তাকে এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
* শ্রমিকের ওপর আল্লাহ যা ফরয করেছেন তা আদায়ের অধিকার :
শ্রমিককে তার ওপর আল্লাহর ফরযকৃত যাবতীয় ইবাদত যেমন সালাত ও সিয়াম ইত্যাদি সম্পাদনের সুযোগ প্রদান করা। একজন দীনদার বা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কিন্তু অন্য যে কারও চেয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বেশি আন্তরিক। কারণ, সে সবার জন্য মঙ্গল সাধন করতে সচেষ্ট থাকে। তার নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারি এবং চুক্তি রক্ষার প্রচেষ্টা সঙ্গত কারণেই বেশি হয়।সাবধান হে মালিক ভাই, আপনার অবস্থান যেন আল্লাহর ইবাদত কিংবা ইসলামের প্রতীক রক্ষার কাজে বাধা প্রদানকারীরদের পক্ষে না হয়। যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‘যারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাত থেকে অধিক পছন্দ করে, আর আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং তাতে বক্রতার সন্ধান করে; তারা ঘোরতর ভ্রষ্টতায় রয়েছে’। {সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ৩}
সৎ কাজে বাধা না দিয়ে বরং তাতে ব্রতী হতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেন,
﴿ أَرَءَيۡتَ إِن كَانَ عَلَى ٱلۡهُدَىٰٓ ١١ أَوۡ أَمَرَ بِٱلتَّقۡوَىٰٓ ١٢ أَرَءَيۡتَ إِن كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰٓ ١٣ أَلَمۡ يَعۡلَم بِأَنَّ ٱللَّهَ يَرَىٰ ١٤ ﴾ [العلق: ١١، ١٤]
‘তুমি কি দেখেছ, যদি সে হিদায়াতের উপর থাকে, অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়? যদি সে মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়? সে কি জানে না যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ দেখেন?’ {সূরা আল-আলাক, আয়াত : ১১-১৪}
শ্রমগ্রহীতা শ্রমিকদের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করবেন। সুন্দর উপায়ে তাদেরকে নিজ ধর্মীয় শিষ্টাচারাবলি আঁকড়ে ধরতে উদ্বুদ্ধ করবেন। কেননা, শ্রমিকদের দীনদারির অনুভূতির লালন-অনুশীলনের মাধ্যমে কাজে তাদের মনোযোগ বাড়বে। এটি তাদেরকে আপন কাজে আরও বেশি নিষ্ঠাবান এবং কাজের স্বার্থ রক্ষায় অধিক যত্নবান বানাবে।
* শ্রমিকের অভিযোগ এবং বিচার প্রার্থনার অধিকার :
শ্রম বিধান পদ্ধতিগত ও প্রায়োগিক বিধিগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে যা শ্রমিকের অভিযোগ ও বিচার চাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে।
বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে ইনসাফ ও ন্যায়ানুগতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। জুলুম ও বঞ্চিত করার মানসিকতা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহতা‘আলা কোনো মানুষের প্রতি জুলুম করেন না; বরং তিনি কোনো প্রকার জুলুম প্রত্যাশাও করেন না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَمَا ٱللَّهُ يُرِيدُ ظُلۡمٗا لِّلۡعِبَادِ ٣١ ﴾ [غافر: ٣١]
‘আর আল্লাহ বান্দাদের উপর কোন যুলম করতে চান না।’ {সূরা আল-মু’মিন, আয়াত : ৩১}
আবূ যর গিফারী রাদিআল্লাহ আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
« يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا ».
‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং একে তোমাদের মাঝেও হারাম করেছি। অতএব তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।’[4]
আর পূর্ববর্তী জাতিগুলো কেবল তাদের জুলুম ও অত্যাচারী আচরণের কারণেই ধ্বংস হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَلَقَدۡ أَهۡلَكۡنَا ٱلۡقُرُونَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَمَّا ظَلَمُواْ ﴾ [يونس: ١٣]
‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা যুলম করেছে।’ {সূরা ইউনুস, আয়াত : ১৩}
আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন,
﴿ فَتِلۡكَ بُيُوتُهُمۡ خَاوِيَةَۢ بِمَا ظَلَمُوٓاْۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَةٗ لِّقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ٥٢ ﴾ [النمل: ٥٢]
‘সুতরাং ঐগুলো তাদের বাড়ীঘর, যা তাদের যুলমের কারণে বিরান হয়ে আছে’। {সূরা আন-নামল, আয়াত : ৫২}
আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেন,
﴿ وَأَنذِرۡهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡأٓزِفَةِ إِذِ ٱلۡقُلُوبُ لَدَى ٱلۡحَنَاجِرِ كَٰظِمِينَۚ مَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ حَمِيمٖ وَلَا شَفِيعٖ يُطَاعُ ١٨ ﴾ [غافر: ١٨]
‘আর তুমি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও। যখন তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে দুঃখ, কষ্ট সংবরণ অবস্থায়। যালিমদের জন্য নেই কোন অকৃত্রিম বন্ধু, নেই এমন কোন সুপারিশকারী যাকে গ্রাহ্য করা হবে। {সূরা আল-মু’মিন, আয়াত : ১৮}
আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেন,
﴿وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِن نَّصِيرٖ ٧١ ﴾ [الحج: ٧١]
‘আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’। {সূরা আল-হাজ, আয়াত : ৭১}
অন্য হাদীসে রয়েছে, জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ».
‘তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো, কারণ জুলুম কিয়ামতের দিন অনেক অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে।’[মুসলিম : ৬৭৪১।]
আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِى لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ » .
‘আল্লাহ জালেমকে অবকাশ দেন। অবশেষে যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন তার পলায়নের অবকাশ থাকে না।’[বুখারী : ৪৬৮৬।]
. গ্যারান্টি বা জামানত লাভের অধিকার :
জামানত বা তাদমীন শব্দটি ফিকহ শাস্ত্রের আধুনিক পরিভাষায় ‘নাগরিক কর্তব্য’ শব্দের প্রতিশব্দ। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে মানুষের জামানত বলতে বুঝায় অন্য কর্তৃক সাধিত ক্ষতির মোকাবেলায় যা প্রদান করা হয়। আর পবিত্র কুরআনও –যা মূলত ইসলামী আইন-আদালতের প্রথম উৎস-সামাজিক দায়িত্বের ধারণাকে সমর্থন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٍ أَن يَقۡتُلَ مُؤۡمِنًا إِلَّا خَطَٔٗاۚ وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَٔٗا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مُّؤۡمِنَةٖ وَدِيَةٞ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦٓ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْۚ ﴾ [النساء: ٩٢]
‘আর কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত (হলে ভিন্ন কথা)। যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে দিতে হবে না)। {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৯২}
তেমনি নানা উপলক্ষ্যে পবিত্র সুন্নাহও একে সমর্থন করেছে, যা ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস। সরাসরি ক্ষতি পূরণে একে সমর্থন করেছে। যেমন আনাস রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَهْدَتْ بَعْضُ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- طَعَامًا فِى قَصْعَةٍ فَضَرَبَتْ عَائِشَةُ الْقَصْعَةَ بِيَدِهَا فَأَلْقَتْ مَا فِيهَا فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- « طَعَامٌ بِطَعَامٍ وَإِنَاءٌ بِإِنَاءٍ ».
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে তাঁর কোনো এক স্ত্রী একটি থালায় আহার হাদিয়া পাঠান। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা তাতে আঘাত করেন। ফলে থালায় যা ছিল তা পড়ে যায়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আহারের বদলে আহার এবং একটি পাত্রের বদলে আরেকটি পাত্র।[তিরমিযী : ১৪১।]
একে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে অন্যের মালিকানাধীন সম্পদের প্রতি নিজের হাত বাড়ায়। অতপর অনুমতি ছাড়া জোরপূর্বক তা হরণ করে বা ধ্বংস করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« عَلَى الْيَدِ مَا أَخَذَتْ حَتَّى تُؤَدِّىَ ».
‘হাত দিয়ে যা গ্রহণ করেছে তার দায়িত্ব তাকে নিতে হবে, যাবৎ সে তা ফেরত দেয়।’[আবূ দাঊদ : ৩৫৬৩; তাবরানী : ৬৮৬২; দারেমী : ২৫৯৬; ইবন মাজা : ২৪০০; তিরমিযী : ১৩১৩; নাসায়ী : ৫৭৮৩; মুসতাদরাক : ২৩০২। আবূ ঈসা বলেন, এটি হাসান সহীহ হাদীস। ইমাম যাহাবী বলেন, হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে বুখারীর শর্ত মোতাবেক, তবে বুখারী বা মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। শায়খ আলবানী হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। কিন্তু শায়খ শু‘আইব আল-আরনাউত মুসনাদের তাহকীকে এর সূত্রকে দুর্বল বললেও বিভিন্ন বর্ণনায় আসার কারণে একে ‘সাহান লিগাইরিহী’ বলেছেন। [আরও দেখুন, মিরকাতুল মাফাতীহ : ৩/৩৫১]]
জোরপূর্বক মালিকানা সূত্রে প্রাপ্ত দায়িত্বের ক্ষেত্রে এটিই মূলনীতি। ফিকহবিদদের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় ‘গছব’ বা অবৈধ আত্মসাৎ।
আর উল্লেখিত নীতিমালার ভিত্তিতে শ্রমিকের জন্য শ্রমগ্রহীতার কাছে জামানতের অধিকার দাবী করার সুযোগ রয়েছে ওই সব শর্তের ভিত্তিতে যা আমরা উল্লেখ করেছি। তার জন্য আরও সুযোগ রয়েছে তার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে বিচার বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَأَوۡفُواْ ٱلۡكَيۡلَ وَٱلۡمِيزَانَ وَلَا تَبۡخَسُواْ ٱلنَّاسَ أَشۡيَآءَهُمۡ وَلَا تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ بَعۡدَ إِصۡلَٰحِهَاۚ ﴾ [الاعراف: ٨٥]
‘সুতরাং তোমরা পরিমাণে ও ওজনে পরিপূর্ণ দাও এবং মানুষকে তাদের পণ্যে কম দেবে না; আর তোমরা যমীনে ফাসাদ করবে না তা সংশোধনের পর’। {সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৮৫}
এসব হলো শ্রমিকের অধিকারগুলোর সবচে গুরুত্বপূর্ণগুলো। এভাবেই ইসলাম শ্রমিকের অধিকার, সম্মান রক্ষা করেছে। তার সম্মানিত জীবন নিশ্চিত করেছে। সর্বোপরি সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছে।
ব্যক্তির যদি দায়িত্ব হয় কাজে নিষ্ঠার পরিচয় দেয়া, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পদ ও মালিকানার সুষম বণ্টন করা। কাজ যদি হয় উৎপাদনের প্রধান স্তম্ভ তবে রাষ্ট্রেরে দায়িত্ব মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো, যারা কাজের মান বাড়াবে এবং তার প্রতি যত্ন নেবে। শ্রমিক যদি হয় প্রকৃত সম্পদ,তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব খেটে খাওয়া লোকগুলোর ওপর চলমান জুলুম বন্ধ, তাদের মজুরি বৃদ্ধি এবং সমান সুযোগ ও স্বাস্থ্য রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া। শ্রমিক যদি হয় খেটে খাওয়া শ্রেণী, তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার ও তার পরিবারের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
পরিশেষে আল্লাহ কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের জাতীয় জীবন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করেন। বিপদগ্রস্তের বিপদ অপসারিত করেন। এবং পরিশ্রমী ব্যক্তিদের শান্ত সম্মানিত জীবনের প্রত্যাশা পূরণ করেন। আমীন।
শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না’- (বুখারি,২/১৩২, বায়হাকি)।
রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে, তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও তাকে পারিশ্রমিক প্রদান করে না’- (বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড:১৩২)।
শ্রমিক-মজুরদের মর্যাদা দেওয়ার আরেকটি প্রামাণ্য ঘটনা আমরা দেখতে পাই হজরত উমর (রা.)-এর জীবনে। তিনি সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর বা খলিফা হয়েও নিজের শ্রমিককে উটের পিঠে চড়িয়ে তার সম্মান, কদর ও মর্যাদা দিতে কোনোরূপ কার্পণ্য করেননি। এরূপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। কবির ভাষায়- ‘ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি/ মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী’- (কাজী নজরুল ইসলাম) ।
আরবের প্রচলিত ভাষা ছিল মালিক ও মনিবকে ‘রাব্ব’ বা প্রতিপালক বলা। কিন্তু পবিত্র ধর্ম ইসলামে এ ধরনের কথাকেও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে মালিকের মনে অহংকারবোধ ও শ্রমিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণা জন্ম হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ”তোমাদের মধ্যে মালিক বা মুনিবকে কেউ ‘রাব্ব’ বলতে পারবে না। কারণ তোমরা সবাই গোলাম বা প্রতিনিধি। একমাত্র আল্লাহই সবার রাব্ব বা প্রতিপালক।”
ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব
জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় শ্রম। এ কারণেই মানবদরদী নবী (সা.) শ্রম বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর, যদি সে হয় সৎ উপার্জনশীল’- (মুসনাদে আহমদ)।
আল কোরআনে ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন সালাত কায়েমের পাশাপাশি উৎপাদনমুখী কর্মে ব্যাপৃত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তাই তো ঘোষণা এসেছে, ‘যখন তোমাদের সালাত শেষ হয়ে যাবে, তবে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো। আর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে যাও’- (৬২:১০)।
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক :
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হবে পিতা-সন্তানের ন্যায়। নিজের পরম আত্মীয়ের মতোই শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রমিককে তার প্রাপ্য পূর্ণভাবে যথাসময়ে প্রদান করাও মালিকের একটি প্রধান দায়িত্ব। অনেক সময় শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মালিকগণ উপযুক্ত মজুরী না দিয়ে যৎ সামান্য মজুরী দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করে। এ ধরনের মালিকদের সম্পর্কে রাসূলুল্ল¬াহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তাদের মধ্যে একজন হ’ল- وَ رَجُلٌ أسْتَأْجَرَ أَجِيْرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ أَجْرَهُ- ‘যে শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না’।বুখারী, মিশকাত হা/২৯৮৪।
অপরদিকে একজন শ্রমিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল- চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ تَعَالَى يُحِبُّ مِنَ الْعَامِلِ إِذَا عَمِلَ أَنْ يُّحْسِنَ- ‘আল্লাহ ঐ শ্রমিককে ভালবাসেন যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে’।ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৯১, হাদীছ হাসান।
কিন্তু কোন কোন শ্রমিক মালিকের কাজে ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত হাযিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করে থাকে, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এজন্য তাকে ক্বিয়ামতের মাঠে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হ’তে হবে। আর যদি শ্রমিক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, তাহ’লে তার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের দ্বিগুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হ’ল- وَالْعَبْدُ الْمَمْلُوْكُ إِذَا أَدَّى حَقَّ اللهِ وَ حَقَّ مَوَالِيْهِ‘ঐ শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক্ব আদায় করে এবং আল্লাহর হক্বও আদায় করে’।বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১১, ‘ঈমান’ অধ্যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, لِلْعَبْدِ الْمَمْلُوْكِ الصَّالِحِ أَجْرَانِ- ‘সৎ শ্রমিকের জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে’। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, وَالَّذِىْ نَفْسُ أَبِيْ هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ لَوْلاَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَالْحَجُّ وَبِرُّ أُمِّىْ لَأَحْبَبْتُ أَنْ أَمُوْتَ وَأَنَا مَمْلُوْكٌ- ‘যেই সত্তার হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ তার কসম! যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হজ্জ ও আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের ব্যাপারগুলো না থাকত, তাহ’লে আমি শ্রমিক হিসাবে মৃত্যুবরণ করতে পসন্দ করতাম’। বুখারী হা/২৫৮৪; মুসলিম হা/৪৪১০।
শ্রমিকদের যে বিষয়টি মনে রাখা যরূরী তা হ’ল- বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে। সুতরাং মে দিবসে যেকোন ব্যক্তির যানবাহন চালানোর বা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খোলা রাখারও অধিকার আছে। তাতে বাধাদানের অধিকার কারো নেই। কিন্তু আমাদের দেশে মে দিবসে যদি কেউ যানবাহন চালায় বা দোকানপাট খোলা রাখে তাহ’লে উচ্ছৃংখল কিছু শ্রমিককে গাড়ি ভাংচুর করতে এবং দোকানপাট জোর করে বন্ধ করে দিতে দেখা যায়। যা আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে হরতাল-ধর্মঘটও বর্জন করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলতে হয়, এ সুন্দর পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতায় শ্রমিকদের কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কিন্তু শত আক্ষেপ! সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণীটি সর্বদাই উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে খেটে যে শ্রমিক তার মালিকের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, সেই মালিকেরই অবিচারে শ্রমিকদের অচল জীবনটি আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এটাকে সেই মৌমাছির সাথে তুলনা করা যায়, যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে একফোঁটা মধুও জোটে না।
তবে যতই দিন গেছে তত শ্রমিক আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশে এখন ৮ ঘন্টা দৈনিক কাজকে আইনগত স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি ১ মে’কে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন কোন কোন দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এমনকি বিপ্লবে পর্যবসিত হয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলন অনেক দূর এগিয়ে গেলেও আজকের বাস্তবতায় শ্রমজীবী মানুষের উপর নতুন করে আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে।
আসুন! মানবরচিত বস্তা পচা মতবাদ সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিকের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ও শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এজন্য সর্বাগ্রে উচিত ইসলাম প্রদর্শিত মালিক-শ্রমিক নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন। মহান আল্লাহ তা’য়লা আমাদের সহায় হোন,হেফাজত করুন আমীন!