আসহাবে রাসূল (সা.) এর আনুগত্য
ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান
লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট। [email protected]
প্রাথমিক কথা ঃ আসহাবে রাসূল (সা.) ছিলেন আনুগত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজী। বিশ^ নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর সকল কথা, কাজ, অনুমোদন ও সম্মতিসমূহকে মুখস্ত করা, মনে রাখা, হিফাজত করা ও হুবহু আমল করার ক্ষেত্রে সাবাহায়ে কেরাম ছিলেন আমাদের প্রেরণার উৎস। সাহাবায়ে কেরাম মহামর্যাদাবান হয়েছেন শুধুমাত্র আনুগত্য ও নবীপ্রেমের কারণে। আসহাবে রাসূল (সা.) আনুগত্যের যে নমুনা বিশ্ববাসীর কাছে রেখে গেছেন, তা কোনো লেখকের লেখনীতে, কোনো কবির কবিতায়, কোনো দার্শনিকের দর্শনে, কোনো বক্তার বক্তৃতায়, কোনো শিল্পীর তুলিতে, কোনো বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানে, এমনকি কোনো গল্পকারের গল্পে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব নয়। সাহাবিদের লাখ লাখ চক্ষু সার্বক্ষণিক রাসুল (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকত। কোনো করণীয় ও বর্জনীয় আমল প্রিয় রাসুল (সা.) থেকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমলে রূপান্তরিত করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। কার আগে কে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। শত্রæ কর্তৃক প্রিয় রাসুল আক্রান্ত হোন কিনা সেদিকে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখতেন। বিশ^নবীর আনুগত্যে ও নবীপ্রেমে তাঁরা নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের আনুগত্য, শৃংখলা ও আপোষহীন আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী নবী (সা.) এর আদর্শ ও ইসলামী বিধান অক্ষুন্ন রয়েছে।
আসহাবে রাসুল (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় ঃ আসহাব বহুবচন এর একবচন সাহাবী। সাহাবী বলা হয় إن الصحابي من لقي النبي -صلى الله عليه وسلم- مؤمنا به ، ومات على الإسلام ) وقال ابن حجر العسقلاني :( هذا أصح ما وقفت عليه في ذلك যারা ঈমানের অবস্থায় স্বীয় জীবদ্দশায় ক্ষণিকের জন্য রসুল (সা.)-কে দেখেছেন তাঁদেরকে সাহাবি বলে। (ইবনে হাজার আসকালানী) সাহাবিদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا (১৮) “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট আছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার নিকট শপথ গ্রহণ করেছিল, আল্লাহ তাদের অন্তরের সব কিছুই অবগত আছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদের আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন।” (সূরা আল ফাতাহ : ১৮)
রাসূল (সা.) এর আনুগত্য আনুগত্য অর্থ মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা, উপরন্তু কোন কর্তৃপক্ষের ফরমান-ফরমায়েশ অনুযায়ী কাজ করা প্রভৃতি। আল কুরআনে এবং হাদিসে রাসূলে এর প্রতিশব্দ হিসেবে যেটা পাওয়া যায় সেটা হলো এতায়াত। এতায়াতের বিপরীত শব্দ হলো মাছিয়াত বা এছইয়ান। যার অর্থ নাফরমানী করা, হুকুম অমান্য করা প্রভৃতি।
মহানবী (সা.) এর আনুগত্যের মানদন্ড ছিলো, আল্লাহ তায়ালার আদেশ নিষেধ হুবহু মান্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
{لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَاليَوْمَ الآَخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرً} [الأحزاب:২১] .
“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূল (সা.) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে চায় ও আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে”। (সূরা আহযাব : ২১)
বিশ^নবীর (সা.) ্আনুগত্য ও ভালোবাসায় উজ্জ্বীবিত হয়ে আসহাবে রাসূল (সা.) তাঁদের সন্তান, প্রিয় মায়ের স্নেহ-মমতা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, ভাই-বোনের হৃদয় নিংড়ানো দরদ, এমনকি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে স্বীয় বাপ-দাদার বসতভিটা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ এবং নিজেদের ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি পেছনে রেখে প্রিয় নবীর সংস্পর্শে লাভের আকাঙ্ক্ষায় অজানা-অচেনা পথ ধরে মদিনা মুনওয়ারায় হিজরত করেছিলেন। পেছনে রেখে আসা সহায়-সম্পত্তির জন্য জীবনে কখনো আক্ষেপ পর্যন্ত করেননি। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৩১) قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ (৩২) “প্রিয় নবী (সা.) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাকারী, পরম দয়ালু। বলুন, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুত, যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আলে-ইমরানের ৩১ ও ৩২)
আনুগত্যের মানদন্ড ঃ মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা.) এর আনুগত্য নিঃসংকোচে প্রশ্নাতিতভাবে করা ফরজ। আনুগত্যর মানদন্ড তথা প্রকৃত আনুগত্য বা প্রকৃত এতায়াত হলো সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর যাবতীয় হুকুম আহকাম মেনে চলা। এটাই মানুষের একমাত্র দায়িত্ব, কর্তব্য এবং করণীয় কাজ যা ইবাদত নামেই অভিহিত। এই প্রকৃত এতায়াতের ব্যবহারিক রূপ হলো:
أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
“আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং উলিল আমরের বা নেতৃবৃন্দ বা দায়িত্বশীলদের আনুগত্য কর।” (আন নিসা: ৫৯)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য চোখ বন্ধ করে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর দায়িত্বশীলদের আনুগত্য হবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ভিত্তিতেই। উল্লেখ্য যে, বিশ^ নবীর আনুগত্য ছাড়া আল্লাহ তায়ালা আনুগত্য হয়ই না। মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন
من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله ومن يطع الأمير فقد أطاعني ومن عصى الأمير فقد عصاني
“যে আমার এতায়াত বা আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমার হুকুম অমান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই অমান্য করল। যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে আমীরের আদেশ অমান্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই আদেশ অমান্য করল (বুখারী ও মুসলিমঃ ২/৭৭)
মহানবী (সা.) এর আনুগত্যের অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে ঃ
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ ্রكُلُّ أُمَّتِيْ يَدْخُلوْنَ الجَنَّةِ إِلَّا مَنْ أَبَىগ্ধ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ، وَمَنْ يأبَى ؟ قَالَ ্রمَنْ أَطَاعَنِيْ دَخَلَ الجَنّةِ، وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ أَبَىগ্ধ. البُخَارِيْ.
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে শুধু যে অস্বীকার করেছে সে ছাড়া। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) কে অস্বীকার করবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে আমার আনুগত্য করল সে জান্নাতে যাবে আর যে আমার অবাধ্য হল বা অমান্য করল, সে অস্বীকার করল। (সহীহ আল-বুখারী ঃ ২/১১২)।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَاب
“রাসূল যা কিছু তোমাদের দেন তা গ্রহণ করো এবং যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন তা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা” (সুরা আল- হাশর ৭)
*নবীজি (সা.) এর আনুগত্যের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন : (فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ (الشعراء : ১৫০
“আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর”। (আশ-শূয়ারা: ১৫০) এভাবে আল্লাহকে ভয় কর, আমার আনুগত্য কর- মক্কী সূরাগুলোতে বার বার এসেছে।
*আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) আনুগত্যের পাশাপাশি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) স্মরাপন্ন হওয়া ঈমানের অপরিহার্য দাবী।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (النساء : ৫৯(
“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর খোদার, আনুগত্য কর রাসূলের এবং সেসব লোকেরও যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্বশীল বা নেতৃবৃন্দ, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) প্রতি অর্পন কর, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটাই উত্তম”। (আন নিসা: ৫৯)
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (النور : ৫১(
“ঈমানদার লোকদের কাজতো এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ডাকা হবে- যেমন রাসূল তাদের মামলা মুকাদ্দমার ফায়সালা করে দেয় তখন তারা বলে: আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম”। (আন নূর: ৫১)
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا (الأحزاب : ৩৬(
“কোন ঈমানদার পুরুষ ও কোন ঈমানদার নারীর এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে ফায়সালা করেন, তখন সে নিজেই সে ব্যাপারে ভিন্ন কোন ফায়সালা করার ইখতিয়ার রাখে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর যারাই আনুগত্যহীনতা দেখাবে তারা প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত”। (আল আহযাব: ৩৬)
উল্লেখ্য যে, আনুগত্য বা এতায়াতকে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি ঈমানের অনিবার্য দাবী হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
*বিশ^নবীজির (সা.) আনুগত্যহীনতাকে মহান আল্লাহ তায়ালার অপছন্দনীয় ও ঘৃণীয় কাজ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে ঃ
مَّنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ وَمَن تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
“যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাই হোক, তাদের ওপর তো আমি তোমাকে পাহারাদার বানিয়ে পাঠাইনি”।
*মানব জীবনের সকল স্তরে যদি আল্লাহ নিদের্শিত এবং রাসূল (সা.) প্রদর্শিত নির্দেশাবলীর প্রতিফলন না ঘটে তবে তা হবে আনুগত্যহীন কাজ এবং তা এক পর্যায়ে মানুষকে কুফরির দিকে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে আল কুরআনের নির্দেশনা হলো :
قُلْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ فإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
“হে নবী! তাদেরকে বলুন, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তবে যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে নিশ্চই আল্লাহ এমন লোকদের মহব্বত করবেন না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে”। (সুরা আল ইমরান: ৩২)
*রাসূল (সা.) এর আনুগত্যের মাধ্যমে জান্নাত ও আল্লাহর রহমত পাওয়ার নিশ্চয়তা বিদ্যমান। মহান আল্লাহ বলেন:
وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রসূলের আনুগত্য করো, আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি করুণা করা হবে”। (সুরা আন-নূর: ৫৬)
*নবী করিম (সা.) এর কোন আনুগত্য তাঁর ফয়সালা, নিয়মাবলী ও কার্যাবলীর ব্যাপারে সামান্যতম কোন ভিন্নতার মনোভাব পোষণ করলে তারা মুমিন হিসেবে গণ্য হবে না। মহান আল্লাহ বলেন:
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا
“না, হে মুহাম্মাদ (সা.), আপনার রবের কসম, তারা কখনো মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ তাদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে তারা আপনাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে, তারপর আপনি যা ফায়সালা করবেন সে ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্য যে কোনো প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেবে।” (সুরা আন-নিসা: ৬৫)
সাহাবায়ে কেরামের আনুগত্যের কতিপয় উজ্জল দৃষ্টান্ত
* কুরাইশদের দূত ওরওয়াহ ইবনে মাসউদ ছাকাফি ঈমান আনার পূর্বে, হুদায়বিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধিচুক্তিকালে, গোয়েন্দা হিসেবে সাহাবিদের অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে মদিনায় আগমন করেছিলেন। মদিনায় কয়েক দিন সাহাবিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পর মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের কাছে সাহাবিদের নবীপ্রেমের কাহিনী এভাবে বর্ণনা দেন ঃ “হে আমার জাতি! আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের পক্ষ থেকে দূত হিসেবে রোমের সম্রাট, ইরানের শাহেনশাহ এবং আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে গিয়েছি। আল্লাহর কসম, কোনো রাজা-বাদশাহর প্রতি তাদের প্রজা ও সহচরদের এমন ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিনি যেরূপ দেখেছি মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের ভালোবাসা। আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মদ (স.)-এর মুখের থুথুকে তারা জমিনে পড়তে দেয় না। অতি ভক্তির কারণে সেই থুথুকে সংরক্ষণ করে রেখে নিজেদের সুঘ্রাণ হিসেবে তা শরীরে ব্যবহার করেন। (উল্লেখ্য, যে রসুল (সা.)-এর থুথু মেশকআম্বর থেকেও বেশি সুঘ্রাণযুক্ত ছিল)। তিনি যখন কোনো কাজের হুকুম দেন তখন সাহাবিদের মাঝে তা পালনের প্রতিযোগিতা লেগে যায়। তার অজুর অতিরিক্ত পানি তারা বরকতের জন্য রেখে দেয়। প্রিয় রসুলের সামনে উচ্চঃস্বরে কথা বলা তারা একেবারেই পছন্দ করেন না। অতি ভক্তির কারণে রসুল (সা.)-এর দিকে চক্ষু তুলে তাকানোরও সাহস পান না।” (মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া ঃ ১৩৮)
* সাহাবায়ে কেরাম মহানবী (সা.)-কে ছায়ার মতো অনুকরণ করতেন। রাসূলের নির্দেশ পালনে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন না। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, “রাসুলূল্লাহ (সা.) যে আমল করতেন তা আমল করা কখনও আমি ত্যাগ করিনি। আমি আশঙ্কা করতাম যদি আমি তা ত্যাগ করার কারণে আবার বিপথগামী হয়ে যাই।” (বিদয়া অননিহায়া ঃ ২/১৭৮)
*বিশ^নবী (সা.) এর হুবহু আনুগত্যের প্রয়োজনে হযরত উমার (রা.) সমস্ত কর্মকান্ডের ফাঁকে পালাক্রমে মহানবী (সা.) এর দরবারে হাজির হয়ে দ্বীনের বিভিন্ন বিধান আয়ত্ব করে সে অনুযায়ী আমল করতেন।
روى البخاري ومسلم عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه وأرضاه قال: كنت أنا وجار لي من الأنصار في بني أمية بن زيد- هذا الجار هو عتبان بن مالك- وكنا نتناوب النزول على رسول الله صلى الله عليه وسلم، ينزل يوما، وأنزل يوما، فإذا نزلت جئت بخبر ذلك اليوم من الوحي، وإذا نزل فعل مثل ذلك.
“হযরত উমার (রা.) বলেন, আমি এবং আমার এক আনসারী বন্ধু- ইতবান ইবন মালেক (রা.)- পরস্পর পালাক্রমে বিশ^নবীজির (সা.) দরবারে দ্বীন শিক্ষতে উপস্থিত হতাম। আমি একদিন যেতাম, তিনি অন্য একদিন যেতেন, আমি যেদিন উপস্থিত হতাম সেদিনকার অহী ও দ্বীনের বিধান আয়ত্ব করে প্রতিবেশীকে জানাতাম। আর তিনিও যেদিন হাজির হতেন সেদিনের অহীর বিধানাবলী আয়ত্ব করে আমাকে জানাতেন।” (বুখারী ও মুসলিম ঃ ১/২৮)
*মহানবী (সা.) এর আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে আসহাবে রাসূল (সা.) সীমাহীন ভদ্রতা, ন¤্রতা ও সর্তকতা অবলম্বন করতেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের সম্মুখে অশেষ আদব ভক্তি ও আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। একটি হাদীসে বর্ণিত আছে- হযরত উসামা ইবনে শরীফ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন নবী করীম (সা.)এর দরবারে উপস্থিত হলাম। হুজুরের চতুর্দিকে সাহাবায়ে কেরাম পরিবেষ্টন করে আছেন। মনে হচ্ছিলো, যেনো তাঁদের মাথায় পাখি বসা রয়েছে। (অর্থাৎ কোনো নড়াচড়া নেই)। (আবু দাউদ ঃ ২/১২৮)
#প্রিয় নবীজির (সা.) কোনো আমল বা কাজ দেখার সাথে সাথেই সাহাবীগণ হুবহু তা করা আরম্ভ করতেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলকে সাওমে বেসাল (লাগাতার রোজা) রাখতে দেখে রোজা রাখতে আরম্ভ করলেন। তখন রাসূল সাওমে বেসাল রাখতে নিষেধ করলে একজন সাহাবা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো সাওমে বেসাল রাখছেন। তখন তিনি এরশাদ করলেন-তোমরা কী আমার মতো? আমাকে তো আমার মহান রব খাওয়ান ও পান করান। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত-১৭৫ পৃষ্ঠা)
*হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) সহ কতিপয় সাহাবী রাসূল (সা.) এর খুটিনাটি সকল আমলকেই অনুসরণ করতেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়।
وَعَنْ مُجَاهِدٍ قَالَ :كُنَّامَعَ ابْنِ عُمَرَ رَحِمَهُ اللَّهُ فِيْ سَفَرٍ فَمَرَّ بِمَكَانٍ فَحَادَ عَنْهُ، فَسُئِلَ لِمَ فَعَلْتَ ذلِكَ؟ قَالَ : رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَ هَذَا فَفَعَلْتُ ‘মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘আমরা একদা এক সফরে ইবনে উমর (রা.) এর সঙ্গে ছিলাম। চলতে চলতে একস্থানে গিয়ে তিনি রাস্তা ছেড়ে অন্য দিকে গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কেন আপনি এমনটি করলেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি রাসূল (সা.)কে এভাবে করতে দেখেছি”। (সুনান সহীহ)
*সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের প্রতি কীরূপ ভক্তি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শন করতেন তা হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনায় বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি। উরওয়া বিন মাসউদকে যখন কুরাইশরা দূত হিসেবে প্রেরণ করে মুসলমানদের অবস্থা জানতে চাইলেন, তখন উরওয়া হুদায়বিয়া নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদের অবস্থা কুরাইশদেরকে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করলেন- উরওয়া স্বচক্ষে নবী করীম (সা.)এর সাহাবাদের দেখতে লাগলো। সে বললো, আল্লাহর শপথ রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নাক মোবারকের পবিত্র শ্লেষ্মা ফেলার সাথে সাথেই তা সাহাবাদের কেউ না কেউ হাতের তালুতে নিয়ে মুখমন্ডল ও শরীরে মালিশ করে নিচ্ছেন। তিনি কোনো আদেশ প্রদানের সাথে সাথেই তারা তা পালন করার প্রতিযোগিতা দিচ্ছেন। তিনি অযু করলে তাঁর অযুর পানি নেয়ার জন্য যেনো তাঁরা যুদ্ধে লিপ্ত হবেন এমন অবস্থা। যখন তিনি কোনো কথা বলছেন, তখন সকলেই স্বীয় কথার আওয়াজ নীচু করে ফেলেন এবং রাসূলের সম্মানের জন্য তাঁর দিকে সরাসরি কেউ চোখ তুলে দৃষ্টিপাত করছেন না। সে তখন তাঁর সাথীদের কাছে ফিরে এসে বললো, হে আমার কওমের লোকেরা! আল্লাহর শপথ, আমি অনেক রাজা-বাদশার দরবারে গিয়েছি। আমি রোম সম্রাট, পারস্য সম্রাট ও আবিসিনিয়ার রাজার দরবারে গিয়েছি। আল্লাহর শপথ! আমি কোনো সম্রাটকে তার প্রজারা এমনভাবে সম্মান করতে কোনোদিন দেখিনি, যেভাবে মুহাম্মদ (সা.)এর সাহাবাকে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে দেখেছি। (বুখারী শরীফ, ২য় খন্ড, ৩৭৯ পৃষ্ঠা)
সীরাতে হালবিয়া শরীফে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বদরের যুদ্ধের প্রাক্কালে সাহাবীদের পরামর্শ নেয়ার সময় কোনো কোনো সাহাবী বড় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিলে প্রিয়নবী অসন্তুষ্ট হন। তখন বড় বড় সাহাবীগণ তা বুঝতে পেরে প্রিয় রাসূলের প্রতি উৎসর্গকৃত বক্তব্য রাখেন। যার সংক্ষিপ্ত সার নি¤œরূপ : “হযরত আবু বকর (রা.) দাঁড়িয়ে মতামত পেশ করলেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষে সুন্দর কথা বললেন, অতঃপর হযরত ওমর (রা.) দাঁড়িয়ে সুন্দরভাবে কথা বললেন, অতঃপর হযরত মিকদাদ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহু! আল্লাহ আপনাকে যা নির্দেশ দিয়েছেন তা বলুন। আমরা আপনার সাথেই আছি আল্লাহর শপথ! আমরা বনী ইসরাঈলের মতো বলবো না। (আপনি ও আপনার প্রতিপালক গিয়ে জিহাদ করুন এবং আমরা এখানে বসে আছি)। যতক্ষণ আমাদের চোখের পলক পড়বে ততক্ষণ আমরা আপনার সাথে জিহাদ করবো, আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে নবী হিসেবে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আপনি যদি আমাদেরকে বারাকাল গামাদ এ নিয়ে যান আমরা সেখানে গিয়েও জিহাদ করবো। (বারাকাল গামাদ হচ্ছে আবিসিনিয়ার একটি শহরের নাম) আমরা আপনার ডান দিকে, বাম দিকে, সামনে ও পেছনে সবদিক থেকে জিহাদ করবো। হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি দেখতে পেলাম এতে রাসূলের চেহারা মুবারক আনন্দে চমকে উঠলো। অথবা (আরেক বর্ণনায় আছে) যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে কোনো সমুদ্রে ঝাঁপ দেন, আমরাও ঝাঁপ দেবো আপনার সাথে, যদি কোনো পর্বতে আরোহণ করেন, আমরাও আপনার সাথে পর্বতে আরোহণ করবো এবং যদি আপনি বারাকাল গামাদ-এ গমন করেন, আমরাও আপনার অনুসরণ করবো।” (বুখারী ২/২৮)
* সাহাবায়ে কেরাম মহানবী (সা.) এর আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো কারণ, হেকমত বা ওজর খুঁজতেন না।
عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنه جاء إلى الحجر الأسود، ولا يعرف الحكمة من ذلك يقول: إني أعلم أنك حجر لا تضر ولا تنفع، ولولا أني رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يقبلك ما قبلتك.
“হযরত উমার ইবন খাত্তাব (রা.) একদা হাজরে আসওয়াদের নিকট এসে (হাজরে আসওয়াদকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে) বললেন ঃ আমি নিশ্চিত জানি তুমি একটি পাথর ছাড়া আর কিছু নও। তুমি কাউকে ক্ষতিও করতে পারো না উপকারও করতে পারো না। আমি যদি বিশ^নবী (সা.) কে তোমাকে চুমা দিতে না দেখতাম তাহলে আমি তোমাকে কখনও চুমা দিতাম না।” (বুখারী ও মুসলিম ৮/৭৭)
*বিশ^নবীর (সা.) আনুগত্যের তাগিদে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর কাছে খোলা মনে প্রশ্ন করতেন। তাদের এরূপ আক্বিদা ছিল না যে, এটা তো একেবারে অদৃশ্য বিষয়, তা তাঁকে কেনো জিজ্ঞাসা করবো? দেখুন একজন প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী হযরত উম্মে হারেসা বিনতে সুরাক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বদর যুদ্ধে শহীদ হওয়া প্রাণপ্রিয় পুত্রের অবস্থান জানতে রাসূলের দরবারে আসলেন। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে (হযরত উম্মে হারেসা বললেন) হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি কী আমাকে আমার ছেলে হারেসা সম্পর্কে বলবেন না? তিনি বদর যুদ্ধে একটি তীরের আঘাতে শহীদ হন। যদি সে বেহেশতে থাকে তাহলে আমি ধৈর্য ধারণ করবো। যদি অন্য কিছু হয় তাহলে আমি তাঁর জন্য কান্নাকাটি করবো। তখন প্রিয়নবী এরশাদ করলেন, হে হারেসার মা? বেহেশতে তো অনেক রয়েছে এবং নিশ্চয়ই তোমার ছেলে সর্বোচ্চ বেহেশত জান্নাতুল ফেরদৌস অর্জন করেছে।” (বুখারী ঃ ২/৭৮)
*সহীহ হাদীস ও বিশ^নবী (সা.) এর সীরাত পাঠের একজন ণ্যূনতম পাঠকও জানেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর লিখিত দাওয়াতের মধ্যে শুধু এতটুকুই থাকতো- “মুসলমান হয়ে যাও, নিরাপদে থাকবে।” আর মৌখিক দাওয়াতের শব্দটিও এমন হতো “তোমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়, বিজয়ী হয়ে যাবে।” (বুখারী ঃ ১/৩) এছাড়া অন্য কোনো বাক্য পাওয়া যায় না। বাস্তবতা হলো, দা‘য়ীর মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, ওই লোকটি ইসলাম গ্রহণ না করলে চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে। মৃত্যুর এক মুহুর্ত গ্যারান্টি নেই। তাকে আগুন থেকে বাঁচাতে হবে। তাহলে সে আর হেকমত আর সুযোগের কথা চিন্তা করবে না। সে অনিচ্ছায় চিৎকার করে উঠবে, বাঁচো ! আগুন থেকে বাঁচো!!
* হযরত আবুবকরের আনুগত্য- “মহানবীকে (সা.) আল্লাহ তায়ালার মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দানের পরই তিনি হযরত আবু বকরকে (রা.) বলেছিলেন, ‘হে আবুবকর মক্কার কাফেলারা বড়ই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কবে কখন হয়ত মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করতে হতে পারে’। হিজরতের রাতে মহানবী (সা.) নিজ বিছানায় হযরত আলী (রা.) কে শায়িত রেখে মদীনার পথে রওনা দিলেন। সাথী হিসেবে বন্ধু আবু বকর (রা.) কে সঙ্গে নেয়ার জন্য তাঁর বাড়ীর সামনে গিয়ে, আবু বকর! বলে একবার ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবু বকর (রা.) বেরিয়ে এলেন। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এলে? জিজ্ঞাসা করলেন হযরত (সা.)। আবু বকর (রা.) বললেন যেদিন আপনি মদীনায় হিজরত করার কথা বলেছিলেন সেদিন হতে একটি রাতের জন্যও আমি বালিশে মাথা রেখে ঘুমাই নি, সারা রাত দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কারণ আমি আরাম করে ঘুমিয়ে থাকবো আর কাফেরেরা আপনাকে ধাওয়া করবে আপনি আমাকে ডেকে ডেকে পাবেন না। কাফেরেরা আপনাকে আঘাত করবে, যখম করবে। আমি আবু বকর এটা সইতে পারবো না।” (বিদায় অননিহায়া ঃ ৩/১৪২)
*রাসূল (সা.) এর যেকোনো আমল দেখার সাথে সাথে আসহাবে রাসূল (সা.) তা করা শুরু করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে –
اتخذ النبي صلى الله عليه وسلم خاتما من ذهب- قبل تحريم الذهب على الرجال- فاتخذ الناس خواتيم من الذهب.
لم يقل لهم البسوا، لكن الصحابة حريصة على أن تقلد الرسول في كل شيء، ثم بعد ذلك قال: إِنِّي اتَّخَذْتُ خَاتَمًا مِنْ ذَهَبٍ، فَنَبَذْتُهُ.
* হযরত উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, স্বর্ণ হারাম হওয়ার পূর্বে মহানবী (সা.) স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করছিলেন, তা দেখে সাহাবায়ে কেরাম স্বর্ণের আংটি ব্যবহার শুরু করলেন। যখন স্বর্ণ হারাম হলো তখন তিনি তা ছুড়ে ফেললেন সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরামও স্বর্ণের আংটি ব্যবহার বন্ধ করে দিলেন। (বুখারী ঃ ২/২৫৬)
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه وأرضاه قال: بينما رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي بأصحابه إذ خلع نعليه، فوضعهما عن يساره، فلما رأى ذلك القوم، ألقوا نعالهم، فلما قضى رسول الله صلى الله عليه وسلم صلاته، قال: “مَا حَمَلَكُمْ عَلَى إِلْقَاءِ نِعَالِكُمْ؟”، قالوا: رأيناك ألقيت نعليك، فألقينا نعالنا. فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: “إِنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ آتَانِي فَأَخْبَرَنِي أَنَّ فِيهِمَا قَذَرٌ. أو قال: أَذًى”.
* হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা মহানবী (সা.) সাহাবীদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করার সময় তাঁর জুতা খুলে বাম পাশে রেখে দিলেন। তা দেখে সাহাবীগণও তাদের জুতাসমূহ খুলে ফেললেন। নামায শেষে মহানবী (সা.) বললেন তোমরা জুতা খুলেছ কেন? সাহাবীগণ বললেন আপনাকে খুলতে দেখেছি তাই আমরাও খুলেছি। তখন নবী (সা.) বললেন আমাকে জিবরাইল (আ.) এসে খবর দিয়েছেন যে আমার জুতাদ্বয়ে ময়লা বা আবর্জনা ছিল।” (আবু দাউদ, আহমদ, দারেমী ঃ ২/২৫৮)
* আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা.) এর তুলনাহীন আনুগত্য
عبد الله بن عمر رضي الله عنهما، عبد الله بن عمر كان يوقف القافلة، وينزل من على ناقته يصلى في بقعة ما أثناء سفرة ركعتين، فاستعجب الناس من هذا الموقف، ولما سئل في ذلك، قال:
في هذا المكان صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم.
* একদা আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা.) সফরের মধ্যে স্বীয় কাফেলা থামিয়ে একখানে সালাত আদায় শুরু করলেন, সাহাবীগণ কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মহানবী (সা.) এখানে নামায পড়তেন।” (বুখারী ঃ ২/২৫৬)
* মহানবী (সা.) এর আনুগত্যের আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) এর সরলতা। একদা মহানবী (সা.) মসজিদে নববীতে খুতবা দিচ্ছিলেন, মসজিদের মাঝখানে এক সাহাবী দাঁড়ানো ছিলেন। তখন নবীজি বললেন ঃ তোমরা বসো”। “اجْلِسُوا”. এসময় আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) মসজিদের দরজা দিয়ে ঢুকতে ছিলেন। তিনি দরজাই বসে পড়লেন।” (সুনান সহীহ)
* হযরত খালিদ ইবনে অলীদের আনুগত্যঃ ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)-এর নেতৃত্বে সাত হাজার মুজাহিদসহ সিরিয়া অভিযানে প্রেরণ করেন। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট মুতাবিক ১৩ হিজরীর ২২ জমাদিউসসানী ৬১ বছর বয়সে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) ইন্তিকাল করেন। হযরত ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) যখন খিলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন তখন মুসলিম বাহিনী ও সিরীয় বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেই যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় হযরত ‘উমর (রা.) হযরত আবূ ‘উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)-কে হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)-এর স্থলে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। হযরত খালিদ (রা.) সঙ্গে সঙ্গে আবু ‘উবায়দা (রা.)-এর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
* হযরত আবু জান্দালের আনুগত্যঃ হুদায়বিয়া সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে সুহাইলের পুত্র হযরত আবু জান্দাল (রা.) মক্কা থেকে পালিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শৃংখলিত অবস্থায় মুসলমানদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা শোনালেন। তাঁকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কি কি ধরণের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা-ও সবিস্তারে খুলে বললেন। অবশেষে তিনি হযরত (সা.)-এর কাছে আবেদন জানালেন : ‘হুযুর আমাকে কাফিরদের কবল থেকে মুক্ত করে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন ।’ একথা শুনে সুহাইল বলে উঠলো : ‘দেখুন, সন্ধির শর্ত অনুযায়ী নিয়ে যেতে পারেন না।’ কারণ সন্ধির একটি শর্ত ছিল “কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদীনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে না”। এটা ছিলো বাস্তবিকই এক নাজুক সময়। কারণ, আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে নির্যাতন ভোগ করছিলেন এবং বারবার ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন : ‘হে মুসলিম ভাইগণ! তোমরা কি আমাকে আবার কাফিরদের হাতে তুলে দিতে চাও?’ সমস্ত মুসলমান এই পরিস্তিতিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলো। হযরত উমর (রা.) তো রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এ পর্যন্ত বললেন যে, ‘আপনি যখন আল্লাহর সত্য নবী, তখন আর আমরা এ অপমান কেন সইব? হযরত (সা.) তাকে বললেন : ‘আমি আল্লাহর পয়গাম্বর, তাঁর হুকুমের নাফরমানী আমি করতে পারিন না। আল্লাহ-ই আমায় সাহায্য করবেন।’ (বুখারী ও মুসলিম ঃ ২/১৯৮)
শেষ কথা ঃ উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের আনুগত্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কীরূপ ছিল তা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি। আসহাবে রাসূলের (সা.) আনুগত্য মুসলিম উম্মাহর সার্বিক কাজের প্রেরণার উৎস। ইহকাল-পরকালের সার্বিক শান্তি, মুক্তি ও নাজাতের জন্য আসহাবে রাসূলের (সা.) আদলে আনুগত্য প্রকাশ করা সার্বিকভাবে সকললে মুসলিমের এবং বিশেষভাবে ইসলামী আন্দোলনের সকল ভাইবোনদের স্থায়ী অজিফা হওয়া উচিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আসহাবে রাসূলের (সা.) জীবনাদর্শের আলোকে সঠিক আনুগত্যশীল বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আমীন।