কুরআন স্টাডি ক্লাস
সূরা আল আন’আম-৩৩-৩৫
১৮-০৫-২০১৯ইং
قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لَا يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآَيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ ৩৩.وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِينَ ৩৪.وَإِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَبْتَغِيَ نَفَقًا فِي الْأَرْضِ أَوْ سُلَّمًا فِي السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآَيَةٍ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدَى فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْجَاهِلِينَ ৩৫.
৩৩. হে মুহাম্মাদ সা.! আমরা একথা অবশ্যই জানি, এরা যে সব কথা বলে ও তৈরী করে, অপবাদ দেয়, তা আপনাকে কষ্ট দেয়,চিন্তিত করে, কিন্তু এরা আসলেই আপনাকে মিথ্যা বলে না বরং এ জালেমরা আসলে আল্লাহর আয়াতকেই অস্বীকার করছে।
৩৪. আপনার পূর্বেও অনেক রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে কিন্তু তাদের ওপর যে মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে এবং যে কষ্ট দেয়া হয়েছে, তাতে তারা সবর করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে গেছে। আল্লাহর কথাগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারোর নেই এবং আগের রাসূলদের সাথে যা কিছু ঘটে গেছে তার খবর তো আপনার কাছে পৌছে গেছে।
৩৫. তবুও যদি তাদের উপেক্ষা আপনার কাছে অসহনীয় হয়ে থাকে তাহলে আপনার যদি কিছু শক্তি থাকে তাহলে আপনি ভূগর্ভে কোন সুড়ংগ খুঁজে নিন অথবা আকাশে সিঁড়ি লাগান এবং তাদের কাছে কোন নিদর্শন আনার চেষ্টা করুন। আল্লাহ তায়ালা চাইলে এদের সবাইকে হেদায়াতের ওপর একত্র করতে পারতেন। কাজেই মূর্খদের অন্তর্ভূক্ত হবেন না।
শাব্দিক বিশ্লেষণ:
يَقُولُونَ الَّذِي لَيَحْزُنُكَ إِنَّهُ نَعْلَمُ قَدْ
তারা তৈরী করে বলে যে-তোমাকে কষ্ট দিয়েছে-নিশ্চয় সে-আমি- জানি-অবশ্যই
بِآَيَاتِ الظَّالِمِينَ وَلَكِنَّ يُكَذِّبُونَكَ لَا فَإِنَّهُمْ
আয়াতকেই-জালেমরা-কিন্তু-আপনাকে মিথ্যা-বলে-না-নিশ্চয় তারা
يَجْحَدُونَ اللَّهِ
অস্বীকার করে-আল্লাহর
فَصَبَرُوا قَبْلِكَ مِنْ رُسُلٌ كُذِّبَتْ وَلَقَدْ
তারা ধৈর্য্য ধারণ করেছে -পূর্বেও কিন্তু-রাসূল-মিথ্যা প্রতিপন্ন-অবশ্যই
أَتَاهُمْ حَتَّى وَأُوذُوا كُذِّبُوا مَا عَلَى
তাদের কাছে পৌছেছে-অতপর কষ্ট দেয়া হয়েছিল-যে ব্যাপারে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে-যা-উপর
وَلَقَدْ اللَّهِ لِكَلِمَاتِ مُبَدِّلَ وَلَا نَصْرُنَا
অবশ্যই আল্লাহ-আল্লাহর কথা-পরিবর্তন করা-না-আমার সাহায্য
الْمُرْسَلِينَ نَبَإِ مِنْ جَاءَكَ
প্রেরিত নবী-হতে-আপনার কাছে পৌছে গেছে
فَإِنِ إِعْرَاضُهُمْ عَلَيْكَ كَبُرَ كَانَ وَإِنْ
যদি-তাদের উপেক্ষা-আপনার উপর বড়-ছিল-নিশ্চয়
الْأَرْضِ فِي نَفَقًا تَبْتَغِيَ أَنْ اسْتَطَعْتَ
জমিন-মধ্যে-সুড়ঙ্গ-আপনি তালাশ করেন-নিশ্চয়ই-আপনি পারেন
بِآَيَةٍ فَتَأْتِيَهُمْ السَّمَاءِ فِي سُلَّمًا أَوْ
আয়াত-তাদেরকে নিয়ে আসেন-আকাশ-মধ্যে-সিড়ি-অথবা
الْهُدَى عَلَى لَجَمَعَهُمْ اللَّهُ شَاءَ وَلَوْ
সঠিক পথ-উপর -একত্রে-আল্লাহ-ইচ্ছা-যদি
الْجَاهِلِينَ مِنَ تَكُونَنَّ فَلَا
অজ্ঞ-হতে-মোটেই নয়-তবে না
নাযিলের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা.) উটের পিঠে সওয়ার থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ সূরাটি একই সাথে নাযিল হয়। মক্কী জীবনের শেষ দিকে । বুখারি-মুসলিম।
আল্লাহর রাসূল যখন মানুষকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবার কাজ শুরু করেছিলেন তারপর থেকে বারোটি বছর অতীত হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশদের প্রতিবন্ধকতা, জুলুম ও নির্যাতন চরমে পৌছে গিয়েছিল। ইসলাম গ্রহণকারীদের একটি অংশ তাদের অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল। তারা হাবশায় (ইথিওপিয়া) অবস্থান করছিল। নবী (সা.) এর সাহায্য-সমর্থন করার জন্য আবু তালিব বা হযরত খাদিজা (রা.) কেউই বেঁচে ছিলেন না। ফলে সব রকমের পার্থিব সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি কঠোর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে ইসলাম প্রচার ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তাঁর ইসলাম প্রচারের প্রভাবে মক্কায় ও চারপাশের গোত্রীয় উপজাতিদের মধ্যে থেকে সৎলোকেরা একের পর এক ইসলাম গ্রহণ করে চলেছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমগ্র জাতি ইসলামকে অস্বীকার ও প্রত্যাখানের গোঁয়ার্তুমি অব্যাহত রেখেছিল। কোথাও কোনো ব্যক্তি ইসলামের দিকে সামান্যতম ঝোঁক প্রকাশ করলেও তার পেছনে ধাওয়া করা হতো। তাকে তিরস্কার, গালিগালাজ করা হতো। শারীরিক দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক, সামাজিক নিপীড়নে তাকে জর্জরিত করা হতো। এ অন্ধকার বিভীষিকাময় পরিবেশে একমাত্র ইয়াসরেবের তথা মদীনা মুনাওয়ারার দিক থেকে একটি হালকা আশার আলো দেখা দিয়েছিল। সেখানকার আওস ও খাযরাজ গোত্রের প্রভাবশালী লোকেরা এসে নবী (সা.) এর হাতে বাই’আত করে গিয়েছিলেন। সেখানে কোন প্রকার আভ্যন্তরীণ বাধা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়েই ইসলাম প্রসার লাভ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ ছোট একটি প্রারম্ভিক বিন্দুর মধ্যে ভবিষ্যতের যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়েছিল তা কোন স্থুলদর্শীর দৃষ্টিগ্রাহ্য হওয়া সম্ভপর ছিল না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতো, ইসলাম একটি দুর্বল আন্দোলন। এর পেছনে কোন বৈষয়িক ও বস্তুগত শক্তি নেই। এর আহবায়কের পেছনে তার পরিবারের ও বংশের দুর্বল ও ক্ষীণ সাহায্য-সমর্থন ছাড়া আর কিছুই নেই। মুষ্টিমেয় অসহায় ও বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিই ইসলাম গ্রহণ করেছে। যেন মনে হয় নিজেদের জাতির বিশ^াস, মত ও পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা সমাজ থেকে এমনভাবে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে যেমন গাছের মরা পাতা মাটির ওপর ঝরে পড়ে।
শানে নুযূল বা আয়াত অবতীর্নের কারণ:-
আয়াতসমুহ অবতীর্নের ব্যাপারে কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়-
১. “মক্কার কাফের-মুশরিকরা মহানবী (সা.) কে অব্যাহতভাবে অস্বীকার, প্রতিবাদ ও নির্যাতন চালাতে থাকে। তাতে মহানবী (সা.) মানষিকভাবে ভেঙ্গে পড়তে থাকেন। তারই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা প্রিয় নবীজিকে (সা.) সান্তনা স্বরূপ আলোচ্য আয়াতসমূহ নাযিল করেন।” ফতহুল কাদির ১/১৮৭
২. কুরাইশ নেতা হারেস ইবনে আমের মহানবী (সা.) কে বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি আমাদের সাথে কখনো মিথ্যা কিছু বলেন নি। এব্যাপারে আপনাকে আমরা বিন্দুমাত্র দোষারূপ করতে পারি না। তবে আমরা যদি আপনার আনিত দ্বীন অনুস্মরণ করি তাহলে এই জমিন থেকে আমাদেরকে ছো মেরে নিমূর্ল করা হবে। তার একথা প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। বুখারী ২/২৩৫
৩. আবু জেহেলসহ বিশিষ্ট কুরাইশ পান্ডাগণ নবীজিকে সব সময় বলত আমরাতো আপনাকে আদৌ মিথ্যাবাদী মনে করি না। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেরা যখন বসত তখন নবীজি আনিত জীবন বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অব্যাহত চক্রান্ত করত। এ প্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয়। বুখারী মুসলিম।
৪. আখনাছ ইবনে শুরাইক আবু জেহেলে সাথে সাক্ষাত করে বলল আপনি আমাকে গোপনে বলুনতো মুহাম্মাদ সা. আসলে কি সত্যবাদী? না তিনি যা বলছেন সবই মিথ্যা? আপনার আমার এ কথা আর কেউ শুনবে না। তখন আবু জেহেল বলল আল্লাহর কসম! নিশ্চয় মুহাম্মাদ সত্যবাদী। কখনো তাকে মিথ্যাবাদী বলার সুযোগ নেই। কিন্তু মুহাম্মাদের বনু কুসাইব গোত্রের হাতে সকল কর্তৃত্ব চলে যাবে! তাহলে বাকী কুরাইশদের কি হবে। এ প্রেক্ষাপটে আয়াত নাযিল হয়। [ তাফসীরে ইবন কাছির ৪/২১৩,ত্ববারী,ফতহুল কাদির]
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা :
#{ قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الذى يَقُولُونَ } মহানবী সা.কে প্রশান্তি স্বরূপ বলা হয়েছে। মক্কার কুরাইশ ও কাফেরদের পক্ষ থেকে অব্যাহত অপবাদ ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে। ক. বাস্তবিকই তারা নবীকে ও নবীর অনুসারীদেরকে মিথ্যাবাদী বলে না। খ. আর যদি মিথ্যাবাদী বলেও তাতেও নবী ও ইসলাম পন্থিদের কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদের কোনো আসর পড়ে না।
#{ فإنهم لا يكذبونك } ক. তারা তাদের গোপন মজলিসে আপনাকে মিথ্যা বলে না। খ. তারা আপনার সামনেও আপনাকে সত্যবাদী বলে কসম খায়।
# وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ– এ রকম অপবাদ, অপপ্রচার ও নির্যাতন সকল নবী রাসূল ও সকল ইসলাম পন্থিদের উপরেই সব সময় ছিল। হক্বের সাথে বাতিলের এ দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী।
# وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ- ক. আল্লাহর কালিমা খ. আল্লাহর বিধান গ. আল্লাহর ওয়াদা ঘ.আল্লাহর সাহায্য ঙ. সত্যের জয়, চ. মিথ্যার পরাজয় এটি স্থায়ী সত্য। আল্লাহর এ বিধান কখনো ব্যতয় ঘটবে না।
#فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَبْتَغِيَ نَفَقًا فِي الْأَرْضِ أَوْ سُلَّمًا فِي السَّمَاء– দ্বীন প্রচারে ও দ্বীন কাজে অগ্নি পরীক্ষা সহ্য করতে না পারলে পরীক্ষা মেনে নেওয়ার মানষিকতা তৈরী না হলে তারা এ পথে টিকে থাকতে পারবে না। তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা চূড়ান্ত ধমক ভৎর্সনা দিয়ে বলেন পারলে জমিন খুঁড়ে পাতালে যান অথবা সিড়ি লাগিয়ে আকাশে উঠেন!
মৌলিক শিক্ষা ও হেদায়াত:
১. মহানবী সা. সহ সকল যুগের ইসলাম পন্থিদের বিরুদ্ধে অপ্রচার, ষড়যন্ত্র চলবেই। এ ব্যাপারে চিন্তা, পেরেশানী ও হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
২. মক্কার কুরাইশ কাফের বেঈমানরা নিশ্চিত ছিল নবীজি সা. ও তার আনিত বিধান অকাট্য সত্য। তেমনিভাবে সকল যুগের ইসলাম পন্থিদের ব্যাপারেও ইসলামের দুশমনেরা অকাট্যভাবে গোপনে সত্য ও সঠিক ধারণা পোষণ করে। বিরোধিতা ও যুলুম যা করে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দের ফল।
৩. মহানবী সা. ও ইসলাম পন্থীদের বিশেষ সান্তনা বাণী।
৪. নবীজি ও ঈমানদারদেরকে সকল ক্ষেত্রে সবর, ধৈর্য্য ও একানিষ্ঠতার পরিচয় দিতে হবে। অতীতের সকল নবীগণ এবঙ সালাফগণ সবরের কারণেই আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় পেয়েছেন। এর বিকল্প চিন্তা করা জাহেলি, মুর্খতা ও আল্লাহর বিধানের সাথে ধৃষ্টতা ও চ্যালেন্জ।
#আহবান,আসুন, দ্বীনি আন্দোলনের এ পথে পরীক্ষা, উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ,সমালোচনা,বিরোধিতা,নির্যাতন সবই সবরের সহিত মোকাবেলা করি। অবোধ-না জানাদের মত আমরাও বিপদগামী হতে পারি না। মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন:- فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْجَاهِلِينَ