প্রশ্ন
আমি ইংল্যান্ড প্রবাসী। প্রত্যেক রমযানে সদাকাতুল ফিতরের টাকা দেশে দিয়ে থাকি। আমাদের এখানের কিছু ভাই বলেন, টাকা দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায় হবে না। সরাসরি গম বা খেজুর ইত্যাদি দ্রব্যাদি দিয়ে দিতে হবে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এ দ্রব্যগুলোর মূল্য দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায় করলে কি তা আদায় হবে না? এ বিষয়ে মিডিয়াতে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। বিস্তারিত দলীল-প্রমাণসহ জানালে উপকৃত হতাম।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
حامدا و مصليا و مسلما
হাদিসে বর্ণিত পাঁচটি বস্তুর মূল্য দ্বারা সদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিষয়টি সাহাবা-তাবেয়ীদের বক্তব্য ও আমল দ্বারা প্রমাণিত।
ইমাম বুখারি (রাহ.) সহিহ বুখারিতে بَابُ العَرْضِ فِي الزّكَاةِ অধ্যায়ে তা‘লীক হিসেবে বর্ণনা করেন যে, তাউস (রহ.) বলেন-
قَالَ مُعَاذٌ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ لِأَهْلِ اليَمَنِ: ائْتُونِي بِعَرْضٍ ثِيَابٍ خَمِيصٍ أَوْ لَبِيسٍ فِي الصّدَقَةِ مَكَانَ الشّعِيرِ وَالذّرَةِ أَهْوَنُ عَلَيْكُمْ وَخَيْرٌ لِأَصْحَابِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالْمَدِينَةِ.
মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) ইয়ামানবাসীদেরকে বললেন, তোমরা যব ও ভুট্টার পরিবর্তে চাদর বা পরিধেয় বস্ত্র আমার কাছে সদকা স্বরূপ নিয়ে আসো। ওটা তোমাদের পক্ষেও সহজ এবং মদীনায় নবী (সা.)-এর সাহাবীগণের জন্যও উত্তম। (সহিহ বুখারি ১/১৯৪; বর্ণনাটি পুরো সনদসহ ‘কিতাবুল খারাজ’ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে আদাম এ রয়েছে। দেখুন : কিতাবুল খারাজ, বর্ণনা: ৫২৫)
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রাহ.) সহিহ বুখারির ভাষ্যগ্রন্থ উমদাতুল কারীতে বলেন-
احتج به أصحابنا في جواز دفع القيم في الزكاة، ولهذا قال ابن رشيد: وافق البخاري في هذه المسألة الحنفية مع كثرة مخالفته لهم، لكن قاده إلى ذلك الدليل.
মূল্য দ্বারা যাকাত-সদাকাতুল ফিতর প্রদান জায়েয হওয়ার স্বপক্ষে এই বর্ণনা আমাদের ইমামগণের দলীল। এজন্যই ইবনে রুশাইদ (রাহ.) বলেন, হানাফী মাযহাবের সাথে অনেক মাসআলায় ইমাম বুখারির মতানৈক্য থাকলেও এ মাসআলায় তিনি হানাফী মাযহাবের সাথে একমত পোষণ করেন। এই মত তিনি অবলম্বন করেছেন দলীলের কারণেই। (উমদাতুল কারী ৯/৪)
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমীরী (রাহ.) বলেন-
والظاهر أنها كانت صدقة الفطر.
এর স্বাভাবিক মর্ম হল, এ কথা মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) সদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে বলেছেন। (ফয়যুল বারী ৩/১১৬)
আর বিভিন্ন বর্ণনা ও মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, মুআয (রা.) এমনটি করেছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই। (দেখুন : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১০৫৩৮; কিতাবুল আমওয়াল, তাহকীকুল আমাল ফী ইখরাজি যাকাতিল ফিতর বিল মাল, আহমাদ আলগুমারী পৃ. ৫২; আবু উবাইদ, পৃ. ৪৫৬)
কুররা (রাহ.) বলেন-
جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ : نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إنْسَانٍ ، أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ.
আমাদের কাছে উমর ইবনে আবদুল আযিয (রাহ.)-এর ফরমান পৌঁছেছে যে, সদাকাতুল ফিতর হচ্ছে প্রত্যেক (সামর্থ্যবান) ব্যক্তির পক্ষ হতে ‘অর্ধ-সা’ (গম) কিংবা তার মূল্য হিসাবে অর্ধ দিরহাম প্রদান করা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা: ১০৪৭০)
ইবনে হাযম (রাহ.) বলেন, উক্ত বক্তব্যটি উমর ইবনে আবদুল আযিয (রাহ.) থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। (দেখুন আলমুহাল্লা ৪/২৫২)
বিশিষ্ট তাবেয়ী হাসান বসরী (রাহ.) বলেন-
لاَ بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ.
মূল্য দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায় করতে কোনো সমস্যা নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা: ১০৪৭১)
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু ইসহাক (রাহ.), যিনি ত্রিশেরও অধিক সাহাবী থেকে সরাসরি হাদিস বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন-
أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطّعَامِ.
আমি তাদেরকে (সাহাবা-তাবেয়ীগণকে) খাবারের মূল্য দ্বারা সদাকাতুল ফিতর আদায় করতে দেখেছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা: ১০৪৭২)
উপরন্তু হাদিস শরিফে সদাকাতুল ফিতরের একটি উদ্দেশ্য বলা হয়েছে طُعْمَةً لِلْمَساكِينِ মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা করা। আর নগদ অর্থের মাধ্যমেও দরিদ্র ব্যক্তিরা প্রয়োজনমতো খাবার সংগ্রহ করতে পারে।
সাহাবী-তাবেয়ীদের উপরোক্ত আসারসমূহকে সামনে রেখে হানাফী মাযহাবের ইমামগণসহ আরো অনেকে মূল্য দ্বারা সদাকাতুল ফিতর আদায় করা জায়েয বলেছেন। এটি সাহাবাদের যুগ থেকেই স্বীকৃত মাসআলা। সুতরাং এ নিয়ে সংশয়-সন্দেহের অবকাশ নেই।
-কিতাবুল আছল ২/১৮০; ইখতিলাফুল উলামা, মারওয়াযী পৃ. ১০৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৫; আলমাবসূত, সারাখসী ২/১৫৬
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم