সন্ত্রাসবাদ ও জংগীবাদ প্রতিরোধে ইসলাম
শাইখ ড. খলিলুর রহমান মাদানী
সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদ, জংগীবাদ, উগ্রবাদ ও চরমপন্থীদের দৌরাত্ম আজ সারা বিশ্বে বিপদজনক আকারে। ইহা ইংরেজী Terrorism এবং আরবী “ইরহাবিয়্যাহ” الارهابية এর প্রতিশব্দ। Terrorism বা সন্ত্রাসবাদ কথা শুনলেই সবার গা শিহরিয়ে ওঠে। সন্ত্রাসবাদ সকল শ্রেনীর মানুষের নিকট অত্যন্ত ঘৃনীয় জিনিষ। ইহা সমাজ জীবনের শান্তি, শৃংখলা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। এজন্য কুরআন, হাদীসের ফয়সালার প্রেক্ষিতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত্য সিদ্ধান্ত হলো- لا ارهابية فى الإسلام “লা ইরহারিয়্যাতা ফিল ইসলাম” অর্থাৎ-“ইসলামের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই।”
ইসলামী জীবন বিধান করুনা ও রহমতে পরিপূর্ন-
সন্ত্রাস একটি মহা জুলুম, ইহা পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, মানুষে-মানুষে সদ্ভাব বিনষ্ট করে জুলুম, নিযার্তন, ভ্রষ্টতা ও নিষ্টুরতার প্রসার ঘটায়। অপর দিকে ইসলাম জীবন বিধান পরিপূর্ন কিতাবের মাধ্যমে মানুষকে মূর্খতা, পথভ্রষ্টতা, নিষ্ঠুরতা ও জুলম- নির্যাতনের অন্ধকার থেকে ঈমান, সুশিক্ষা, রহমত, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব ভালোবাসাও ইনসাফের প্রতি আহবান করেছে।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট ঘোষনাঃ- وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ “হে রসূল (সাঃ) আমি আপনাকে কেবলমাত্র বিশ্ব জাহানের রহমত স্বরুপই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
হাদিসে বলা হয়েছে-خير الناس من ينفع الناس “সব চেয়ে ভালো মানুষ যিনি মানুষকে উপকার করেন।” (সহীহ বুখারী)
ইসলামী জীবন বিধানে সকলের কল্যান নিশ্চিত করা হয়েছে-
ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যা শত্র“তা ও দুশমনি থেকে মুক্ত রেখে মানব মন্ডলীকে পারষ্কপারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রতি সর্বদা আহবান করে নিশ্চিত করা হয়েছে সকলের কল্যাণ। আল্লাহ তায়ালার বাণীঃ-وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الإثْمِ وَالْعُدْوَانِ
“তোমরা ভালোকাজ ও তাকওয়ার কাজে পারস্পারিক সাহায্য করো, আর অন্যায় ও শত্র“তার কাজে একে অপরকে সাহয্য করবে না।” (সূরা মায়েদা, আয়াত-২) অকল্যাণকর কোন কাজ ইসলাম সমর্থন দেয় না।
ভালো কাজের প্রতি আহবানের নিদের্শঃ-
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য আহবান করে। আল্লাহ তায়ালার বাণীঃ-
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
“তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের বের করা হয়েছে- তোমার মানুষকে ভালো কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় – ঘৃনীয় ও অপছন্দীয় কাজ থেকে মানুষকে বাধা দিবে।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)
হাদীস শরীফে বলা হয়েছেঃ- রসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন-
من راى منكم منكرا فليغيره بيده فان لم يستطيع فبلسانه وان لم يستطيع فبقلبه وذلك اضعف الإيمان-
“তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ দেখে তাহলে সেটাকে হাত দ্বারা প্রতিহত করবে, তাতে যদি সক্ষম না হয় তবে জবান দ্বারা পরিবর্তন করবে, তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দ্বারা (অন্যায় পরিবর্তনের জন্য অন্তরে অন্তরে পরিকল্পনা করবে) আর এটি (শেষের পদ্ধতিটি) সব চেয়ে দূর্বল ঈমান।” (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
সকল কর্মকান্ডের জবাব দিহিতার ব্যবস্থা।
ইসলাম এমন একটি দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষকে সৎ ও কল্যানকর কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়, যাতে সর্ব সাধারনের শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। মানুষের সকল কাজের জবাব দিহিতা করতে হবে এবং সকল প্রকার ভালো কাজের উপযুক্ত প্রতিদানও আল্লাহ তায়ালা দেয়ার জন্য প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার বাণী- وَقُلِ اعْمَلُوا فَسَيَرَى اللَّهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ وَالْمُؤْمِنُونَ “হে রসূল (সঃ) আপনি বলে দিন, তোমরা আমল করো, অচিরেই আল্লাহ তায়ালা, তার রসূল (সাঃ) এবং মু’মিনগণ তোমাদের আমল সমুহ (কাজ কর্ম সমূহ) সঠিক ভাবে দেখবেন।” (সূরা তাওবা, আয়াত-১০৫) অতএব জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখিন হওয়া এবং জবাব দিহিতার অনুভূতি থাকলে কোন মানুষ সন্ত্রাস করতে পারে না। পারে না অন্যায়ভাবে কারোর উপর আক্রমন করতে।
অধিকার আদায়রে জন্য ফাসাদ ও সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করা নিকৃষ্টতম হারাম কাজ।
ইসলামী জীবন দর্শন মানুষকে দ্বীন ও দুনিয়ার সকল ব্যাপারে সুষ্পষ্ট সমাধান দিয়েছে। কিন্তু দ্বীন ও দুনিয়ার এ সকল কার্যবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে কোন রকমের জুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাস, ফিতনা- ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টির পথে অগ্রসর হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
وَابْتَغِ فِيمَا آَتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآَخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ
অর্থঃ আল্লাহ আপনাকে আখেরাতী জিন্দেগির যা কিছু দিয়েছেন তা অনুসন্ধান করুন, আর দুনিয়ায় আপনার অংশ ভুলে যাবেন না। আল্লাহ তায়ালা আপনার প্রতি যেমনি অনুগ্রহ করেছেন তেমনি অপরের প্রতি অনুগ্রহ করুন, পৃথিবীর বুকে ফেতনা-ফাসাদ, বিশৃংখলা সৃষ্টি করবেন না, আল্লাহ তায়ালা ফেতনা-ফাসাদ বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের আদৌ পছন্দ করেন না। (সুরা আল কাসাস, আয়াত-৭৭)
সকল ধর্মের পূর্ন ধর্মীয় স্বাধীনতা
ইসলামী জীবন বিধান জাতি ধর্ম, রং, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠত করেছে। এমনকি অমুসলিমদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ধর্মীয় স্বাধীনতা সবই নিশ্চিত করা হয়েছে পবিত্র ইসলামে। অমুসলমান কাফের, ইহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ সকলের পূর্ন ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে পূর্ণমাত্রায়। অমুসলিম বলে তাদের সাথে শত্র“তা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। বরং ইসলামী আইনে অমুসলিমদের সুযোগ, সুবিধা, নিরাপত্তা ও পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ
“যদি কোন মুশরিক আপনার (রাসুল সঃ) কাছে নিরাপত্তা চায় তাহলে তাকে নিরাপত্তা দিন, যাতে সে আল্লাহর কালাম শোনার সুযোগ পায়, অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছেদিন।” (সুরা তাওবা, আয়াত-৬)
মুসলিমদের সমাজে অমুসলিম সম্প্রদায় একটি পবিত্র আমানত। তাদের পূর্ণমাত্রায় ধর্মীয় ও সামগ্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের উপসনালয় পাহারা দেয়, সংরক্ষণ করা ও নির্বিঘেœ উপাসনা করার পরিবেশ নিশ্চিত করা ঈমানদারদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।
হিকমত ও বিবেক বুদ্ধির সমন্বয়েই সার্বিক কল্যাণ নিহিত।
উগ্রতা ও সন্ত্রাস পরিহার করে ইসলামী জীবন বিধানে যে কোন ধরনের জংগী তৎপরতা এবং সন্ত্রাস তৈরী হতে পারে এমন সব ধরনের চিন্তা-পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করে সকল ব্যাপারে শলা-পরামর্শ, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান বের করতে বলা হয়েছে। ইসলামী অনুশাসনের প্রতি আকৃষ্ট করার পদ্ধতিই হলো হিকমত ও বিবেক বুদ্ধির সমন্বয় করে দাওয়াত দেয়া। জোর জবরদস্তি উগ্রতা ও সন্ত্র্রাসের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তায়ালার বাণী- ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ.
“আপনার রবের রাস্তায় হিকমত ও উত্তম নসিহতের মাধ্যমে আহবান করুন। আর বিতর্ক করলেও উত্তম ভাবে করুন।” (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)
কারো অনিষ্ট করা যাবে না-
ইসলামী শরীয়তের বিধানই হলো অন্য কোন মানুষের প্রতি অনিষ্ট না করা। বুখারী মুসলিম শরীফের এক হাদীসে এসেছে “যার হাত ও জবানের অনিষ্টতা হতে অপর মানুষ নিরাপদ থাকে প্রকৃত সেই মুমিন। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু যর (রাঃ) থেকে বর্নিত অন্য এক হাদীসে এসেছে রসুল (সাঃ) বলেছেনঃ- تكف شرا عن الناس فا نها صدقة منك – “তোমার অপকারিত ও অনিষ্ট থেকে অপর সকল মানুষকে নিরাপদে রাখতে হবে। ইহাই তোমার জন্য সদকা” (বুখারী মুসলিম)
সন্ত্রাসবাদ ঈমানদারের কাজ নয়-
কোন মুমিন সন্ত্রাসী কার্য কলাপে জড়িত থাকতে পারেনা। এ ব্যপারে হযরত উমার (রাঃ) থেকে বর্নিত এক হাদীসে বলা হযেছে- “যে অবৈধ পন্থায় রক্তপাত ঘটায় সে কখনও ঈমানদার হতে পারে না” (বুুখারী)
সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত শায়েস্তা করার বিধান-
ইসলামী দর্শনে সন্ত্রাসের সমস্ত পথ বন্ধ করার পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার বিধান নিশ্চিত করেছে। কারন সস্ত্রাসীদেরকে উপযুক্ত সাজা না দিলে সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েই চলবে।
আল্লাহ তায়ালার বাণী- إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ …………………. الخ
“যারা মুহারাবা বা ডাকাতী ও সন্ত্রাস করে এবং জমিনের বুকে ফিতনা, ফাসাদ, বিশৃংখলা সৃষ্টি করে তাদেরকে হত্যা করতে হবে অথবা শুলে চড়াতে হবে অথবা বিপরিত মুখী হাত পা কাটতে হবে অথবা জেলে দিতে হবে।” (সুরা আল মায়িদা) আলকুরআনের এ বিধানের আলোকে যাদি সন্ত্রাসীদেরকে সাজা দেয়া হয় তাহলে কেউ আর সন্ত্রাসী করতে সাহস পাবে না। আমাদেরকে অপরেশন ক্লিনহার্ট ও র্যা বের কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগনের বাস্তব ফল উপভোগ করছে।
ইসলামী আইনের মূলনীতি (permanent rules of Islamic law) বিষয়ক গ্রন্থ الاشباه والنظائر- (রচনায় ইমাম সুয়ুতি ও ইবনে নাজিম) গ্রন্থে কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে স্থায়ী নীতি জারী করা হয়েছে- بقاء ماكان على أمان “সর্বাবস্থায় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।”
অর্থাৎ সব ধরনের সন্ত্রাস দমন করে সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃংখলা নিশ্চিত করাই হলো ইসলামী আইনের অন্যতম মূলনীতি।
ইসলামী আইনের অন্য একটি মূলনীতি হলো:-
إن أمور المسلمين محمولة على السدادو الصلاح- (الأشباه والنظائر)
“নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হবে শৃংখলা, কল্যানকর , সংশোধনীয় ও হিতকর কাজে।,, (ইমাম সুয়ুুতি ও ইমাম ইবনে নাজিম)
অতএব এ সমস্ত মূলনীতির আলোকে ফিতনা, ফাসাদ, বিশৃংখলা, যুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অপকর্ম, অনৈতিক কর্মকান্ড উগ্রবাদ, জংগীবাদ ও সকল ধরনের সন্ত্রাসী কাজ কোন মুসলমান করতে পারে না।
ইসলামী জিহাদ সম্পর্কে অপব্যাখ্যা-
এক সময় ইংরেজ ঐতিহাসিকগন একচোখা দৈত্যের ন্যায় নিবির্চারে ইসলামী জিহাদকে এবং রসুল (সাঃ) পরিচালিত অভিযান সমূহকে ধর্মযুদ্ধ, জংগীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, আখ্যা দিয়ে ঘোষনা করেছিল ইসলামের ইতিহাস রক্তের ইতিহাস, এরই সুত্র ধরে তথাকথিত পরজীবি বুদ্ধিজীবিরা দেশে দেশে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমান করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ ইসলামী জিহাদের মূল তাৎপর্যই হলোঃ- আল্লাহ তায়ালার জমীনে তাঁরই বিধান জারী করার জন্য প্রানন্তকর প্রচেষ্টা, জিহাদ অর্থ রক্তপাত নয়। যারা জিহাদ অর্থ রক্তপাত ঘটানো বা ধর্মযুদ্ধ বলে ব্যাখা করে তারা আসলে তাঁরা জ্ঞানপাপী। ইসলামের সিদ্ধান্ত হলো যে সন্ত্রাস করবে তার মুসলমান দাবী করার অধিকার নেই। আবার যিনি ইসলামী জিহাদকে অপব্যাখ্যা করে সন্ত্রাস ও জিহাদকে এক বানাতে অপচেষ্টা করবে সে নিকৃষ্টতম ইসলামের দুশমন। মূলত: সন্ত্রাসী জঙ্গীর কোন ধর্ম নেই, পরিচয় নেই। পরিচয় তার একটিই সে সন্ত্রাসী।
প্রথম স্তর-دعوة إلى الله (আল্লাহর দিকে ডাকা)
জাতি ধর্ম, বর্ন নিবিশেষে সকল মানুষকে আল্লাহতায়ালার দ্বীনের প্রতি আহবান করা।
اخراج العباد من عبادة العباد إلى عبادة الله –
“মানুষকে বান্দার গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলাম বানানোর জন্য আহবান করার নাম ইসলামী জিহাদ।” ইহা জিহাদের প্রথম স্তর।
দ্বিতীয় স্তর- شهادة على الناس (মানুষের সামনে সত্যের সাক্ষ্য হওয়া)
অন্যমানুষকে যে বিষয়ের প্রতি ডাকা হবে সে ব্যাপারে নিজে আমাল করে দেখাতে হবে। নিজের বাস্তব আমলের মাধ্যমে অন্যকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করাই জিহাদের দ্বিতীয় স্তর।
তৃতীয় স্তর- إقامة دين (দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা)
উপরোক্ত দুটি স্তর পার হয়ে সর্বত্র আল্লাহ দ্বীন কায়েমের জন্য নানামুখী কর্ম সূচী গ্রহন করা। সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ইসলামী কানুন জারীর জন্য নানামূখী কৌশল পদ্ধতি আবিস্কার করা ও বাস্তবায়নের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করাই ইসলামী জিহাদের তৃতীয় স্তর।
চতুর্থ স্তর- قتال في سبيل الله (আল্লাহর রাস্তায় “কিতাল” সংগ্রাম বা যুদ্ধ করা)
উপরোক্ত স্তর সমূহ পার হওয়ার পর যদি কোথাও কোন কুফরী শক্তি ইসলামী ব্যবস্থাকে মেনে না নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অথবা সরাসরি আক্রমন করে, কেবল মাত্র তখনই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারনের অনুমতি দেয়া হয়েছে আত্মরক্ষা ও দেশ রক্ষার জন্য।
এজন্য ইসলামী ফিকহে বলা হয়েছে- الجهاد فرض كفاية اذا هجموا “অমুসলমান যখন মুসলিমদের উপর আক্রমন করবে তখনই জিহাদ ফরজ (কেফায়া),, {শহরে বেকায়া, ফতওয়ায়ে শামী} অতএব বুঝা গেল যে ‘‘জিহাদ” এবং ‘‘ কিতাল” আদৌ এক জিনিস নয়। আবার এ ‘‘কিতাল” কে আল্লাহ তায়ালা চার স্তরে বিধান সম্মত করেছেন।
১) জুলুম নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার অনুমতি
আল্লাহ তায়ালার বাণী- اذن للذين يقاتلون بأنهم ظلموا ‘‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে তাদেরকেও (যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া হয়েছে কেননা তারা নির্যাতিত।” নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রথম পর্যায়ে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
২) মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষন
মানুষের ধর্মীয় অধিকার সহ সকল প্রকার মৌলিক অধিকার সংরক্ষনের মাধ্যমে শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জালিমের জুলুম থেকে মজলুম ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ারে জন্যে এবং মানুষের ইজ্জত আবরুর হেফাজতের জন্য যুদ্ধের জন্য আহবান করা হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ-
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا، الَّذِينَ آَمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا،
“কি কারন থাকতে পারে যে, তোমরা আল্লাহর পথে সেই সব পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য কিতাল (সংগ্রাম) করবে না যারা দূবর্ল হওয়ার কারণে নিপীড়িত হচ্ছে এবং ফরিয়াদ করছে যে, হে আমাদের রব এই জনপদ হতে বের কর, যার অধিবাসীগন অত্যাচারী, এবং তোমার নিজের নিকট হইতে আমাদের বন্ধু, দরদী ও সাহায্যকরী পাঠাও। যারা ঈমানের পথ গ্রহন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। অতএব তোমরা শয়তানের সংগী সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর। নিঃসন্দেহে শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই অত্যন্ত দূর্বল। (সুরা নিসা, আয়াত-৭৫-৭৬)
৩) অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের বিধান জারী
যালিমের যুলম থেকে মযলুম জনগোষ্ঠিকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর বিধান জারী করার মাধ্যমে মানবমন্ডলীর সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানবতা ও মনুষ্যত্বের দুশমন, ষড়যন্ত্রকারী, কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠির আগ্রাসনের স্বার্বিক মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনে “কিতাল” স্বশস্ত্র সংগ্রামকে ফরজ করা হয়েছে। এবং তা করা হয়েছে মানবতার বৃহত্তম স্বার্থে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার বাণী-كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ “তোমাদের জন্য যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর তা তোমাদের অসম্ভব মনে হচ্ছে।” (সুরা বাকারা, আয়াত-২১৬)
আলোচ্য আয়াতে সরাসরি “কিতাল” এর বিধান জারী করা হয়েছে।
৪) সংগ্রাম(قتل قتال)
সকল প্রকারের অন্যায় যুলুম নির্যাতন, ফিতনা ফাসাদ ও বিশৃংখলা দুর করার জন্য قتل قتال তথা চূড়ান্ত সংগ্রাম করতে নির্দেশ দেযা হয়েছে। ইসলামী জিহাদের এ পর্যায়টি ডাক্তারের পক্ষ থেকে রুগীর প্রান রক্ষার প্রয়োজনে সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে অস্ত্র পাচারের সাথে তুলনা করা য়ায়।
আল্লাহর বাণীঃ- وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ “তাদের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র সংগ্রাম করুন যতক্ষন পযর্ন্ত সম্পূর্ন রুপে ফিতনা-ফাসাদ দুরীভূত না হয় এবং পরিপূর্ন রুপে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়”। (সূরা আনফাল, আয়াত-৩৯)
{তথ্য সুত্রঃ আল্লামা ড. শানকেতীর السياسة الشرعية ইমাম মাউরদীরঃالأحكام السلطانية }
উল্লেখ্য যে, প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে চুড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের নির্দেশ দেয়া হলেও সুস্পষ্ট ভােেব নীতি মালা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা দিলেনঃ- وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ- “যে মানুষ হত্যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন তাকে অন্যায় ভাবে হত্যা করো না।” (সুরা আনয়াম-১৫১)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ- ولا يجرمنكم شنان قوم على ان لا تعدلوا اعدلوا هو اقرب للتقوى-
“কোন জাতির প্রতিশত্র“তা যেন তোমাদেরকে বে- ইনসাফী করতে প্ররোচিত না করে, ইনসাফ করো, তা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী ” (মায়িদা-৮)
এ ব্যাপারে রসুল (সাঃ) দ্ব্যর্থ কন্ঠে ঘোষণা করেছেন ঃ- وَمُطَّلِبُ دَمِ امْرِئٍ بِغَيْرِ حَقٍّ لِيُهَرِيقَ دَمَهُ
অবৈধ পন্থায় বা নাহক্বভাবে কোন মানুষকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা। রক্তপাত, হত্যা, সন্ত্রাস, জঙ্গিতৎপরতা ইসলামে নিকৃষ্টতম অমার্জনীয় অপরাধ। বুখারী মুসলিম শরীফ সহ সকল সহীহ কিতাবে বলা হয়েছে, “একমাত্র মুসলমান সেই দাবী করতে পারবে, যার হাত ও জবান থেকে অন্য সকলে নিরাপদ থাকে।” (বুখারী শরীফ: ১:১৯৮) এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একমাত্র ইসলামী জীবন বিধানই জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, যদি কেউ তার ভাইয়ের দিকে তরবারি, লাঠি, চাকু, ছুরি বা পিস্তল উচু করে, তাহলে তাকে আল্লাহর সমস্ত ফিরিশতা লা’নত দিতে থাকেন। (সুনান) এজন্য না হক্বভাবে বা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা জঘন্যতম অপরাধ, ঘৃনীয়-মালা’উন ও অভিশপ্ত।
প্রশ্ন উঠতে পারে আলোচ্য হাদীসে বলা হচ্ছে: নাহক বা অন্যায়ভাবে হত্যার ষড়যন্ত্র করা জঘন্যতম অপরাধ, তাহলে হক্বভাবে হত্যা বলতে কিছু আছে কিনা? এর উত্তর হলো ইসলাম নির্ধারিত حدود বা قصاص অর্থাৎ চুরি করলে চোরের হাত কাটা, মানুষ হত্যা করলে তাকে সরকারিভাবে قصاص নিয়ে হত্যা করা ইত্যাদি حدود তথা দন্ডবিধি বা قصاص তথা রক্তপন কে হক্ব বা ন্যায়সঙ্গত হত্যা আখ্যা দেয়া হয়েছে। তবে বিশেষভাবে সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে যে, হত্যার বদলে হত্যা বা حدودও قصاص কোন ব্যক্তি সংস্থা বা সংগঠন করতে পারবে না। এ বিধান কার্যকর করবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে একমাত্র সরকারি প্রশাসন। তথাকথিত গোমরাহ, ভ্রান্ত-জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের প্রবক্তাদের কার্যকলাপ, সিরিজ বোমা-হামলা, বেহেশতের মিথ্যা প্রলোভন দেখানো এ সবই গোমরাহী ও মিথ্যা ফানুস তারা নিকৃষ্ট অভিশপ্ত।
অপরদিকে যারা কোন নির্দোষ নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যার জন্য বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে। এসব অসৎ উদ্দেশ্য ও ঘৃন্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ানের জন্য বিচারের নামে নানামুখী প্রহসন করে। চোর, ডাকাত ও বিভিন্ন সাজাপ্রাপ্ত আসামী দিয়ে মিথ্যা সাক্ষীর আসর সাজিয়ে নিস্কলুষ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যার নানামুখি চক্রান্ত করে অন্যায়ভাবে খুন করতে চায়। তাদেরকেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষথেকে নিকৃষ্ট অভিশপ্ত মানুষ বলে ঘোষনা করা হয়েছে।
অন্য হাদীসে বলা হয়েছে ঃ-
اغزوا بسم الله فى سبيل الله قاتلوا من كفر بالله اغزوا ولا تغدروا ولا تغلوا ولا تمثلوا ولا تقتلوا وليدا-
“আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে আল্লাহ পথে অভিযান করো, কাফিরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, খবরদার যুদ্ধে কারোর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা ও ওয়াদা খেলাপ করো না, আত্মসাত করবে না, লাশ বিকৃতি করবে না এবং কোন শিশুকে হত্যা করবে না।” (সুনান)
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন, ইসলামী জিহাদ এবং কিতাল এক জিনিস নয়। ইসলাম একমাত্র জীবন বিধান যা সকল ধর্মের, সকল বর্ণের, সকল গোষ্ঠীর, সর্বশ্রেনীর মানুষের নিরাপত্তার জন্য নিশ্চিত আইন জারী করেছে।
যা উপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে লক্ষনীয় যে, বিগত কয়েক বছর যাবত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মহল মুসলিম উম্মাহ, ইসলামী সংগঠন ও সংস্থা সমূহের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করার অপপ্রয়াসের পাশাপাশি তাদের উপর জুলুম নির্যাতন অথবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বৈধ প্রমান করার জন্য উল্টো ইসলাম পন্থীদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়ার তামাশায় মেতে উঠেছে। ক্ষেত্র বিশেষে তাদের পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তথাকথিত ভুইভোড় ইসলামী জংগী সংগঠন গড়ে তুলে ইসলামী সংস্থা সমুহের বিরুদ্ধে ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে মত্ত রয়েছে। এক শ্রেনীর প্রচার মাধ্যম ও এ সমস্ত তথাকথিত জংগী সংগঠনের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও সাজানো কল্পনাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ইসলাম পন্থীদের উপর আঘাত করার প্রেক্ষাপট তৈরী করছে। অথচ ইসলাম, মুুসলমান, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী শিক্ষা সর্বদা সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা নিমূর্লের অতন্ত্র প্রহরী। তাই আসুন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে মৌলবাদী, উগ্রবাদী, জংগীবাদী ও সন্ত্রাসীর ধোয়াতুলে আন্তর্জাতিক সকল কুফরি শক্তি যে সমস্ত ষড়যন্ত্র ও তথ্য সন্ত্রাসে ঝাপিয়ে পড়ছে তার মোকাবিলায় ধৈর্য্যসহকারে ইসলামের আলোচ্য শিক্ষাসমূহকে জনগনের সামনে প্রকাশ করি। ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা ও ইসলামী মূল্যেবোধের ভিত্তিতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজগঠনে আত্মনিয়োগ করি। আমিন। ছুম্মা আমিন॥ ২৩/৮/২০০৪