প্রশ্ন
আমাদের পরস্পরের মাঝে যে হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি কাটাকাটি হয়, এ থেকে দূরে থেকে আমরা কীভাবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে পারি?
উত্তর
بسم الله الرحمٰن الرحيم. حامدا و مصليا و مسلما
ইসলাম আমাদেরকে যে বিধান দিয়েছে তার চেয়ে সুন্দর বিধান পৃথিবীতে আর কেউ দিতে পারেনি। এই বিধানগুলোর একটি হল ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রক্ষা করা। হাদিস শরিফে এসেছে,
لا تدخلوا الجنة حتى تؤمنوا، ولا تؤمنوا حتى تحابوا
‘তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং তোমরা পরস্পরকে মহব্বত না করা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৪]
প্রকৃত মুমিন হতে হলে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে। রাসূল (সা.) সর্বদা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রক্ষা করে চলেছেন। তার জীবনী পাঠ করলেই বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। একটি সহিহ হাদিসে এসেছে,
أَنَّ امْرَأَةً، جَاءَتْ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ بِبُرْدَةٍ – قَالَ وَمَا الْبُرْدَةُ قَالَ الشَّمْلَةُ – قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي نَسَجْتُ هَذِهِ بِيَدِي لأَكْسُوَكَهَا . فَأَخَذَهَا رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ مُحْتَاجًا إِلَيْهَا فَخَرَجَ عَلَيْنَا فِيهَا وَإِنَّهَا لإِزَارُهُ فَجَاءَ فُلاَنُ بْنُ فُلاَنٍ – رَجُلٌ سَمَّاهُ يَوْمَئِذٍ – فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا أَحْسَنَ هَذِهِ الْبُرْدَةَ اكْسُنِيهَا . قَالَ “ نَعَمْ ” . فَلَمَّا دَخَلَ طَوَاهَا وَأَرْسَلَ بِهَا إِلَيْهِ فَقَالَ لَهُ الْقَوْمُ وَاللَّهِ مَا أَحْسَنْتَ كُسِيَهَا النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ مُحْتَاجًا إِلَيْهَا ثُمَّ سَأَلْتَهُ إِيَّاهَا وَقَدْ عَلِمْتَ أَنَّهُ لاَ يَرُدُّ سَائِلاً . فَقَالَ إِنِّي وَاللَّهِ مَا سَأَلْتُهُ إِيَّاهَا لأَلْبَسَهَا وَلَكِنْ سَأَلْتُهُ إِيَّاهَا لِتَكُونَ كَفَنِي . فَقَالَ سَهْلٌ فَكَانَتْ كَفَنَهُ يَوْمَ مَاتَ
‘এক মহিলা একখানা চাদরসহ রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার পরার জন্য আমি নিজ হাতে এটা বুনেছি। চাদরের প্রয়োজন অনুভব করে রাসূল (সা.) তা গ্রহণ করলেন, অতঃপর সেটাকে লুঙ্গীর মত করে পরিধান করে আমাদের নিকট আসলেন। তখন অমুকের পুত্র অমুক এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! চাদরটা কী চমৎকার। এটা আমাকে পরতে দিন। রাসূল (সা.) বলেন, আচ্ছা। তিনি ভিতর বাড়িতে গিয়ে চাদরটা ভাঁজ করে তার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন তাকে বললো, আল্লাহর শপথ! কাজটা তুমি ভালো করোনি। নবী (সা.) প্রয়োজন অনুভব করেই তা পরেছিলেন। আর তুমি তাঁর নিকট থেকে সেটা চেয়ে নিলে! অথচ তুমি জানো যে, তিনি কোন প্রার্থীকেই বিমুখ করেন না। সে বললো, আল্লাহর শপথ! আমি এটা পরার জন্য তাঁর থেকে চেয়ে নেইনি, বরং আমার কাফন বানানোর জন্য চেয়ে নিয়েছি। সাহল (রা.) বলেন, লোকটা যেদিন মারা গেল সেদিন সেটিই তার কাফন হলো।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৫৫৫]
দেখুন, রাসূল (সা.)-এর মাঝে কি পরিমাণ ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল। মদীনার হিজরতের পর মুহাজির সাহাবীগণের প্রতি আনসারী সাহাবীগণ যে ভ্রাতৃত্ববোধ দেখিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। সহিহ বুখারিতে একটি হাদিস এসেছে,
قَالَ عَبْدُ الرَّحْمٰنِ بْنُ عَوْفٍ لَمَّا قَدِمْنَا الْمَدِينَةَ آخَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنِي وَبَيْنَ سَعْدِ بْنِ الرَّبِيعِ فَقَالَ سَعْدُ بْنُ الرَّبِيعِ إِنِّي أَكْثَرُ الأَنْصَارِ مَالاً فَأَقْسِمُ لَكَ نِصْفَ مَالِي وَانْظُرْ أَيَّ زَوْجَتَيَّ هَوِيتَ نَزَلْتُ لَكَ عَنْهَا فَإِذَا حَلَّتْ تَزَوَّجْتَهَا قَالَ فَقَالَ لَهُ عَبْدُ الرَّحْمٰنِ لاَ حَاجَةَ لِي فِي ذَلِكَ هَلْ مِنْ سُوقٍ فِيهِ تِجَارَةٌ قَالَ سُوقُ قَيْنُقَاعٍ قَالَ فَغَدَا إِلَيْهِ عَبْدُ الرَّحْمٰنِ فَأَتَى بِأَقِطٍ وَسَمْنٍ
‘আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা যখন মদীনায় আসি, তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার এবং সা‘দ ইবনু রাবী (রা.)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করে দেন। পরে সা‘দ ইবনু রাবী (রা.) বললেন, আমি আনসারদের মধ্যে অধিক ধনাঢ্য ছিলাম। আমার অর্ধেক সম্পত্তি তোমাকে বণ্টন করে দিচ্ছি এবং আমার উভয় স্ত্রীকে দেখে যাকে তোমার পছন্দ হয়, বল আমি তাকে তোমার জন্য পরিত্যাগ করব। যখন সে (ইদ্দত পূর্ণ করবে) তখন তুমি বিবাহ করবে। আবদুর রহমান (রা.) বললেন, এ সবে আমার কোন প্রয়োজন নেই। বরং (আপনি বলুন) ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো কোন বাজার আছে কি? তিনি বললেন, কায়নুকার বাজার আছে। পরদিন আবদুর রহমান (রা.) সে বাজারে গিয়ে পনীর ও ঘি (খরিদ করে) নিয়ে আসলেন।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০৪৮]
আরেক হাদিসে এসেছে,
‘আনসার সাহাবীগণ নবীজীকে বললেন, আমাদের খেজুর বাগানগুলো মুহাজির ভাই ও আমাদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিন। নবীজী তাদের এ প্রস্তাব নাকোচ করে দিলেন। তাই আনসারগণ মুহাজিরগণকে বললেন, তোমরা শুধু আমাদেরকে চাষাবাদের কাজে সাহায্য করবে আর আমরা তোমাদেরকে ফসলের ভাগ দিব। অবশেষে তারা সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৩২৫]
কী পরিমাণ ভ্রাতৃত্ববোধ তাদের মাঝে ছিল। অথচ বর্তমানে আমরা কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে আসি না। আমরা বলি কিন্তু তদানুযায়ী আমল করি না। আমার ভয় হয়, না জানি আমরা কুরআনের এই আয়াতের অধীনে পড়ে যাই,
لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ
‘তোমরা তা কেন বল, যা তোমরা কর না?’ [সূরা সাফ, আয়াত: ২]
হাদিস শরিফে এসেছে রাসূল (সা.) বলেছেন,
وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ
‘বান্দা যতক্ষন তার ভাই এর সাহায্যে নিয়োজিত থাকে আল্লাহ ততক্ষন তার সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৬০৮]
কিন্তু বর্তমানে আমরা মুমিন ভাইকে তো সাহায্য করছিই না, বরং তার সাথে মতের অমিল হলেই তাকে গালাগালি করছি। কাফের বলে ফাতওয়া দিচ্ছি। অথচ দেখুন, চার ইমামের মাঝে মাসআলাগত অনেক পার্থক্য ছিল। কিন্তু তাদের কেউ অপরকে গালি দেননি। বাতিল বলেননি। আজ আমাদের মাঝ থেকে ভ্রাতৃত্ব চলে গিয়েছে। কালিমা পড়ার দ্বারা একজন মুসলিম যে অপর মুসলিমের ভাই হয়ে যায় তা আমরা ভুলে গিয়েছি। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ
‘যদি তারা তাওবা করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।’ [সূরা তওবা, আয়াত: ১১]
আরেক আয়াতে এসেছে,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ [সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১০]
সাহাবায়ে কেরামের ভ্রাতৃত্ববোধের ব্যাপারে একটি ঘটনা সবারই জানা আছে যে, ‘মদীনায় একটি পরিবার ছিল খুবই অভাবগ্রস্ত। তাদের কাছে ছাগলের একটি মাথা ছাড়া কিছুই ছিল না। যখন তাদের নিকট এছাড়া অন্য কিছু আসল তারা বলল, হায় যদি ছাগলের মাথাটি আমাদের চেয়ে অভাবী কাউকে দান করে দিতে পারতাম। অতঃপর তারা সেটি এক দরিদ্র পরিবারে পাঠিয়ে দিল। এই পরিবারও পূর্বের পরিবারের ন্যায় তাদের চেয়ে বেশি প্রয়োজনগ্রস্ত মনে করে মাথাটি অন্য এক বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। এভাবে ছাগলের মাথাটি মদীনার বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরতে লাগল। এক পর্যায়ে সর্বপ্রথম যেই বাড়ি থেকে তা দান করা হয়েছিল সেই বাড়িতেই ফিরে এল।’ [হিলয়াতুল আওলিয়া, আবু নুয়াঈম ৩/৩৩৮]
এটিই ছিল সাহাবায়ে কেরামের ভ্রাতৃত্ববোধ। অথচ আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াই। হিংসা করি। এটি তো ইসলামের শিক্ষা না। আমাদের হওয়ার দরকার ছিল আয়নার মত। যেমনটি রাসূল (সা.) বলেছেন,
الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ
‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ।’ [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯১৮]
আয়নায় যেমন নিজেকে দেখা যায় ঠিক তেমনি আমি আমার ভাইয়ের মাঝে আমাকে দেখব। আমার ভাইকে আমার মতই মনে করব। এটিই হল ভ্রাতৃত্ব। আর এই গুণ অর্জন করতে হলে আমাদেরকে উদার হতে হবে। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীলদের গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন,
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ
‘ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪]
তাই আসুন আমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করি।
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم