প্রশ্ন
মদকে আল্লাহ তাআলা এক সাথে হারাম না করে কেন পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে হারাম করেছেন?
উত্তর
بسم الله الرحمٰن الرحيم. حامدا و مصليا و مسلما
মদ বা মাদকদ্রব্যকে আল্লাহ তাআলা পর্যায়ক্রমে হারাম করেছেন। এর কারণ হল, জাহেলী যুগে মদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। মানুষ মদপানে এতটাই অভ্যস্ত ছিল যে, মদকে স্বাভাবিক পানীয়র মত মনে করত।
তাই মদকে একবারে হারাম করা হলে মানুষের মাঝে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশংকা ছিল। এ কারণে আল্লাহ তাআলা মাদককে চারটি পর্যায়ে হারাম করেছেন।
প্রথম পর্যায়: আল্লাহ তাআলা কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন যে, তোমরা খেজুর ও আঙ্গুর দ্বারা মাদক তৈরির পাশাপাশি উত্তম খাদ্য বস্তুও তৈরি করে থাক। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالْأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا
‘আর খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক।’ [সূরা নাহল, আয়াত: ৬৭]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সরাসরি মাদক হারাম করেননি, তবে জানিয়ে দিলেন, মাদক ভিন্ন জিনিস। আর উত্তম খাদ্যবস্তু ভিন্ন জিনিস। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম ধারণা করে নিলেন যে, মাদক সম্পর্কে কোনো বিধান আল্লাহ তাআলা অচিরেই নাজিল করবেন।
দ্বিতীয় পর্যায়: এরপর সাহাবায়ে কেরাম যখন মাদক সম্পর্কে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেন তখন আল্লাহ তাআলা কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিলেন যে, মদের মাঝে উপকার ক্ষতি উভয়ই রয়েছে। তবে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণটা বেশি। কুরআনে এসেছে,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا
‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।’ [সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৯]
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে মাদকের প্রতি কিছুটা ঘৃণার সৃষ্টি করে দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম দু’দলে ভাগ হয়ে গেলেন। একদল ক্ষতির দিক বিবেচনায় তা বর্জন করলেন। আরেকদল চিন্তা করলেন, যেহেতু কিছুটা উপকার রয়েছে তাই তা গ্রহণে কোনো সমস্যা হবে না।
তৃতীয় পর্যায়: এ পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছেও যাওয়া যাবে না। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى
‘হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না।’ [সূরা নিসা, আয়াত: ৪৩]
এই আয়াত নাজিলের পর আরো কিছু সাহাবী মদকে বর্জন করলেন। তবে মদ সরাসরি হারাম না করার কারণে অল্প কিছু সংখ্যক সাহাবী তখনো নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময় মদ পান করতেন।
চতুর্থ পর্যায়: পরিশেষে আল্লাহ তাআলা কুরআনের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে মদকে চূড়ান্তভাবে হারাম করে দিলেন। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ [সূরা মায়েদা, আয়াত: ৯০]
আয়াতটি শ্রবণ করা মাত্রই সাহাবায়ে কেরাম চিৎকার করে বলে উঠেন, انتهينا انتهينا। অর্থাৎ, আমরা বর্জন করলাম, আমরা বর্জন করলাম। তারা তাদের মদের কলসগুলোকে মদীনার অলিগলিতে ঢেলে দেন। এই ঘটনার দিকেই নিম্নোক্ত হাদিসটিতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন,
كُنْتُ سَاقِيَ الْقَوْمِ يَوْمَ حُرِّمَتِ الْخَمْرُ فِي بَيْتِ أَبِي طَلْحَةَ وَمَا شَرَابُهُمْ إِلاَّ الْفَضِيخُ الْبُسْرُ وَالتَّمْرُ . فَإِذَا مُنَادٍ يُنَادِي فَقَالَ اخْرُجْ فَانْظُرْ فَخَرَجْتُ فَإِذَا مُنَادٍ يُنَادِي أَلاَ إِنَّ الْخَمْرَ قَدْ حُرِّمَتْ – قَالَ – فَجَرَتْ فِي سِكَكِ الْمَدِينَةِ فَقَالَ لِي أَبُو طَلْحَةَ اخْرُجْ فَاهْرِقْهَا . فَهَرَقْتُهَا
‘মদ হারাম হওয়ার দিন আমি আবু তালহার ঘরে লোকদের মদ পান করাচ্ছিলাম। তারা শুকনো ও কাঁচা খেজুরের মদ পান করতো (অর্থাৎ শুকনো ও কাঁচা খেজুর দ্বারা তৈরি ঘন তৈলাক্ত ও সিরকা পান করতো)। হঠাৎ শুনা গেল জনৈক লোক ঘোষণা দিচ্ছে। তিনি বললেন, বের হয়ে দেখো। আমি বের হয়ে দেখলাম, এক লোক ঘোষণা দিচ্ছে: শুনে রাখো, মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, অতঃপর মদীনার চারপাশে ও অলিগলি দিয়ে মদের ঢল প্রবাহিত হতে থাকে। আবু তালহা আমাকে বললেন, বের হও এবং এগুলো ঢেলে দিয়ে আসো। অতঃপর আমি সেগুলো ঢেলে দেই।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫০২৫]
এভাবে পর্যায়ক্রমে আল্লাহ তাআলা মাদককে চিরদিনের জন্য হারাম করে দেন। শুধু হারামই নয়, বরং যারা এই মদের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে, তাদের সকলের প্রতি অভিসম্পাতও করেন। হাদিস শরিফে এসেছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَعَنَ اللَّهُ الْخَمْرَ، وَشَارِبَهَا، وَسَاقِيَهَا، وَبَائِعَهَا، وَمُبْتَاعَهَا، وَعَاصِرَهَا، وَمُعْتَصِرَهَا، وَحَامِلَهَا، وَالْمَحْمُولَةَ إِلَيْهِ
‘রাসূল (সা.) বলেছেন: মদ পানকারী, পরিবেশনকারী বিক্রেতা, ক্রেতা, উৎপাদক ও শোধনকারী, যে উৎপাদন করায়, সরবরাহকারী এবং যার জন্য সরবরাহ করা হয়- এদের সকলকে আল্লাহ লানত করেছেন।’ [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৬৭৪]
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم