প্রশ্ন
বর্তমানে দেখা যায়, কারও সাথে কারও মতের অমিল হলেই অমুকের দালাল, তমুকের দালাল ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে থাকে। ইসলাম এটিকে কীভাবে দেখে?
উত্তর
بسم الله الرحمٰن الرحيم. حامدا و مصليا و مسلما
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছে,
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]
আমাদেরকে সর্বোত্তম উম্মত বলে আখ্যায়িত করা হলেও মুসলিমরা যাবতীয় সমস্যার সম্মুখীন। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল আমাদের মাঝে ঐক্যবদ্ধতা না থাকা। অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন,
وَٱعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُواْ
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩]
আরেক আয়াতে এসেছে,
وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُواْ وَٱخْتَلَفُواْ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَٰتُ
‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৫]
আরেক আয়াতে বলা হয়েছে,
وَ لَا تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ
‘তোমরা সাহস ও ক্ষমতাহারা হয়ে যাবে যদি নিজেদের মধ্যে বিবাদ কর।’ [সূরা আনফাল, আয়াত: ৪৬]
এছাড়াও আরো অনেক আয়াতে অনৈক্যকে ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। তবে ইসলাম একটি স্বভাবজাত ও প্রাকৃতিক ধর্ম। তাই মানুষের মাঝে বিভিন্ন মত থাকতেই পারে। এটি দোষণীয় নয়। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
‘আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না।’ [সূরা বাকারা, আয়াত: ৩০]
এই আয়াতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ফেরেশতারা নিজেদেরে মতামত পেশ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ কারণে তাদেরকে ভর্ৎসনা করেননি। অনুরূপভাবে আরেক আয়াতে এসেছে,
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِ الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي
‘আর যখন ইবরাহীম বলল ‘হে, আমার রব, আমাকে দেখান, কিভাবে আপনি মৃতদেরকে জীবিত করেন। তিনি বললেন, তুমি কি বিশ্বাস করনি’? সে বলল, ‘অবশ্যই হ্যাঁ, কিন্তু আমার অন্তর যাতে প্রশান্ত হয়’।’ [সূরা বাকারা, আয়াত: ২৬০]
এই আয়াত থেকেও বুঝা যায়, মতামত প্রকাশ বা ভিন্নমত পোষণ করা দোষণীয় নয়। হাদিস শরিফে এসেছে হুদাইবিয়া সন্ধির সময় উমর (রা.) রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন,
يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَسْنَا عَلَى حَقٍّ وَهُمْ عَلَى بَاطِلٍ قَالَ ” بَلَى ” . قَالَ أَلَيْسَ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَهُمْ فِي النَّارِ قَالَ ” بَلَى ” . قَالَ فَفِيمَ نُعْطِي الدَّنِيَّةَ فِي دِينِنَا وَنَرْجِعُ وَلَمَّا يَحْكُمِ اللَّهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ
‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা কি সত্যের উপর নই আর তারা বাতিলের উপর নয়? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ তাই। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের নিহত (শহীদ)রা কি জান্নাতী এবং তাদের নিহতরা কি জাহান্নামী নয়?। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, তাহলে কী কারণে আমরা দ্বীনের ব্যাপারে যিল্লাতি মেনে নিয়ে ফিরে যাবো, অথচ এখনো এ ব্যাপারে তাদের ও আমাদের মধ্যে আল্লাহর কোন ফয়সালা করেননি!’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৪৮২]
এক্ষেত্রে উমর (রা.) ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন কিন্তু রাসূল (সা.) তাকে ভর্ৎসনা করেননি।
উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে তিনি মহর বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত পাশ করতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল মহরের একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া। যেন কেউ এর চেয়ে অধিক মহর নির্ধারণ করতে না পারে। তাৎক্ষণিক একজন নারী কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে তার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। তখন উমর (রা.) তার সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা থেকে ফিরে আসেন। এবং বলেন,
امْرَأَةٌ أَصَابَتْ وَرَجُلٌ أَخْطَأَ
‘নারীটি যথার্থ বলেছে আর পুরুষ ভুল করেছে।’ [তাফসীরে কুরতুবী ১/২৮৭; আউনুল মাবুদ ৬/৯৫]
দেখুন, উমর (রা.) তাকে ভর্ৎসনা করেননি। তাই মানুষের মতের ভিন্নতা থাকবেই। একারণে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন,
وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَٰحِدَةً
‘আর যদি আল্লাহ চাইতেন, তোমাদের সকলকে এক জাতিতে পরিণত করতেন।’ [সূরা নাহল, আয়াত: ৯৩]
তাই মতের ভিন্নতা দোষণীয় নয়। তবে এই ভিন্নতা থাকার কারণে কাউকে গালিগালাজ করা, তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেওয়া, বিভিন্ন ট্যাগ লাগানো দোষণীয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ সকল দোষ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم