প্রশ্ন
হাদিসে যে বলা হয়েছে, রোজা ঢাল স্বরূপ- এ কথাটির অর্থ কী?
উত্তর
بسم الله الرحمٰن الرحيم. حامدا و مصليا و مسلما
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন,
الصِّيَامُ جُنَّةٌ فَإِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ صَائِمًا فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَجْهَلْ فَإِنْ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ إِنِّي صَائِمٌ
‘রোজা (একটি) ঢাল, কাজেই তোমাদের যে কেউ রোজাদার হও, সে বাজে কথা বলবে না এবং বর্বরতার কাজ করবে না। যদি কোনো ব্যক্তি তাকে গালি দেয় অথবা কাটাকাটি-মারামারি করতে আসে, তবে সে যেন বলে, আমি রোজাদার, আমি রোজাদার।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৯৪]
এই হাদিসটি একাধিক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে। সকল রেওয়ায়েতকে একত্রিত করলে রোজার ঢাল হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
কুরআন হাদিসে রোজার অনেক উপকারিতার কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকারিতা হল তাকওয়া অর্জিত হওয়া। এ সম্পর্কে কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।’ [সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩]
দেখুন, তাকওয়া ও ঢালের মাঝে এক ধরনের মিল রয়েছে। ঢাল সকল ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। তাকওয়ার প্রকৃত অর্থ এটিই। অর্থাৎ যাবতীয় ক্ষতিকর বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। রোজা ঢাল হিসেবে কিভাবে কাজ করে এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,
مَنْ صَامَ يَوْمًا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللّٰهِ بَعَّدَهُ اللّٰهُ مِنْ جَهَنَّمَ كَبُعْدِ غُرَابٍ طَائِرٍ وَهُوَ فَرْخٌ حَتّٰى مَاتَ هَرِمًا
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সওম রাখে, আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নাম থেকে ওই উড়তে থাকা কাকের দূরত্বের পরিমাণ দূরে রাখবেন, যে কাক বাচ্চা অবস্থায় উড়তে শুরু করে বৃদ্ধ অবস্থায় মারা যায়।’ [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১০৮০৮]
আরেক হাদিসে এসেছে,
مَنْ صَامَ يَوْمًا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنْ النَّارِ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًا
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় এক দিনও সিয়াম পালন করে, আল্লাহ্ তার মুখমণ্ডলকে দোযখের আগুন হতে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেন।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৮৪০]
আরেক হাদিসে এসেছে,
مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ جَعَلَ اللَّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّارِ خَنْدَقًا كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একদিন সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তি ও জাহান্নামের মাঝে একটি খন্দক সৃষ্টি করে দিবেন। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের দূরত্বের পরিমাণ।’ [সুনানে তিরমিযী, হাদিস: ১৬৩০]
হাদিসগুলো থেকে এটিই থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ঢাল যেমন মানুষকে হেফাজত করে, বিভিন্ন ক্ষতিকর বিষয় থেকে দূরে রাখে। ঠিক রোজাও মানুষকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। শুধু জাহান্নামই নয়, বরং যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে। এমনকি সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকেও। কারণ যে ব্যক্তি সন্দেযুক্ত বিষয়ে জড়িয়ে যায় সে হারামের মাঝে পড়ে যায়। হাদিস শরিফে এসেছে,
إن الحلال بين، وإن الحرام بين، وبينهما مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس، فمن اتقى الشبهات استبرأ لدينه، وعرضه، ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام
‘রাসূল (সা.) বলেছেন: হালাল বা বৈধ সুস্পষ্ট এবং হারাম বা অবৈধও সুস্পষ্ট আর এ দুয়ের মধ্যবর্তী বিষয়গুলো হলো সন্দেহজনক। আর বেশীর ভাগ লোকই সেগুলো (সম্পর্কে সঠিক পরিচয়) জানে না। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সন্দেহজনক জিনিসিগুলোকে পরিহার করলো সে তার দ্বীন ও মান-সম্মানকে পবিত্র রাখলো। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক জিনিসে জড়িয়ে পড়লো সে হারামের মধ্যে পড়ে গেল।’ [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৩২৯]
তবে মনে রাখতে হবে, রোজা তখনই ঢাল হবে যখন তা গুনাহমুক্ত হবে। কেউ যদি গুনাহমুক্ত রোজা রাখতে পারে তাহলে এই রোজাই তার মাঝে উত্তম চরিত্র তৈরি করবে, যাবতীয় মন্দ চরিত্রকে বের করে দিবে। ঢাল স্বরূপ কাজ করবে। তাকে মুত্তাকী হতে সহায়তা করবে। তার জন্য বড় একটি পাথেয় হবে। আল্লাহর কাছে ইহকাল ও পরকালের পুরষ্কারের জন্য যথেষ্ট হবে। এ কারণেই রাসূল (সা.) বলেছেন,
لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الْأَكْلِ وَالشُّرْبِ، إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ
‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। বরং অন্যায়, অহেতুক ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।’ [মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস: ১৫৭০; সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস: ১৯৯৬]
আরেক হাদিসে এসেছে,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০৩]
হাদিসে قَوْلَ الزُّورِ দ্বারা উদ্দেশ্য হল কথার দ্বারা যে সকল অপকর্ম হয়ে থাকে তা। আর وَالْعَمَلَ بِهِ দ্বারা উদ্দেশ্য হল যাবতীয় অন্যায়মূলক কর্মকাণ্ড। সুতরাং আমরা যদি গুনাহমুক্ত রোজা পালন করতে পারি তাহলেই সেই রোজা আমাদের জন্য ঢাল হবে। আমাদের উপকারে আসবে।
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم