বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
“মসজিদ ইবাদাত ও সামাজিক কার্যক্রমের স্থান”
মসজিদ মুসলমানদের সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ইসলামের প্রথম যুগ থেকে মসজিদ সমূহ সেভাবেই পরিচালিত হয়েছে।
১। ড: আব্দুল আযিয “রেসালাতুল মসজিদ ফিল ইসলাম” গ্রন্থে মসজিদের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তা হলো ঃ
◙ মুসলমানদের অন্তরে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করা। বিভিন্ন কর্মসূচী, জ্ঞানচর্চা ও ইবাদাতের মাধ্যমে অন্তরে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করে অনুকূল পরিবেশের মাধ্যমে তাকে লালন-পালন করা।
◙ মুসলমানদের জীবনে রূহানী মূল্যবোধকে স্থায়ী করা। মসজিদে ইবাদাত ও রহমাতের (বেদআত মুক্ত) পরিবেশ আল্লাহর সাথে আত্মার গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করা।
◙ মুসলিম ঐক্য সুদৃঢ় করা। অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মসজিদের যাবতীয় তৎপরতা নিবদ্ধ থাকে।
◙ মুসলমানের জীবনে সহযোগিতা ও সহমর্মীতার ভাব সৃষ্টি করা। মসজিদে পরস্পর পরিচিতি লাভের পর একে অপরের সুখ-দুঃখে অংশ গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কর্মসূচীর মাধ্যমে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরী করা।
◙ মুসলমানের জীবনের উন্নত চরিত্র ও উত্তম মানবীয় গুণাবলী সৃষ্টি করা। মসজিদে তাত্বিক ও বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবাধিকার ও মানবতার মুক্তির অনুভূতি জাগ্রত করা হয়।
◙ সর্বোত্তম উপায়ে মসজিদে ইবাদাত বন্দেগীর সুযোগ রয়েছে। মসজিদের দ্বীনি ও নৈতিক পরিবেশের আধ্যাত্মিক ছোঁয়ায় গভীর মনোযোগের সাথে আল্লাহর ইবাদাত করা যায় যা অন্য কোন জায়গায় সম্ভবপর নয়।
◙ মুসলমানের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতির উন্নয়ন করা। ইসলামী জীবন বিধানের আওতায় ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশ সাধন করা জরুরী। মসজিদ হচ্ছে, ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্র। মসজিদ থেকে যে সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হবে তা অন্য যে কোন সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবীদার হবে। ইসলামী সংস্কৃতি বলতে, আচার-অভ্যাস, কৃষ্টি, আনন্দ উৎসবসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে গৃহীত পদ্ধতির মডেলকে বুঝায়। মসজিদ সেগুলোকে জাহেলিয়াত তথা অনৈসলামী পদ্ধতি থেকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে।
◙ সমাজ সংস্কার মসজিদের অন্যতম লক্ষ্য। মানব সমাজে প্রচলিত মানুষের সৃষ্ট মতবাদ ও আমলের মাধ্যমে যে কুসংস্কার ও কুপ্রথা চালু হয় তা সমাজের গতিশীলতার জন্য বিরাট বাধা। সেই কুসংস্কারকে মোকাবিলা করতে না পারলে সমাজকে আকাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই মসজিদের শিক্ষার মাধ্যমে ঐ সকল কুসংস্কার দূর করে সমাজে প্রগতির ধারা সৃষ্টি করা হয়।
◙ সমাজ কল্যাণ মসজিদের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমস্যাগ্রস্ত লোকদের সমস্যার সমাধান করে তাদেরকে সমাজে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করা জরুরী। সমাজ কল্যাণের লক্ষ্যে পৌছার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমাজকর্ম কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। মসজিদের রয়েছে সেই অপূর্ব সুযোগ। সংশ্লিষ্ট এলাকার লোক ও মুসল্লীদের সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে গোটা সমাজ সমস্যা মুক্ত হতে পারে।
◙ ওপরে বর্ণিত সকল লক্ষ্যের সফল বাস্তবায়নের জন্য জ্ঞান চর্চার প্রয়োজন। মসজিদে ইসলামের জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে এ সকল লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সহজ। বরং জ্ঞান চর্চাকে সর্বাধিক বড় লক্ষ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। মসজিদ হচ্ছে, আল্লাহ্ প্রেমিকের আকুতি-মিনতির কেন্দ্র। তাই জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন ঃ
“কত দরবেশ ফকির রে ভাই মসজিদের আঙ্গিনাতে,
আল্লাহ্র নাম জিকর করে লুকিয়ে গভীর রাতে।”
মসজিদের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান হয়। মুয়াযযিনের আযানেরও রয়েছে সুললিত কণ্ঠস্বর।
তাই একই কবি বলেছেন ঃ
‘ও আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক,
কোকিলের কুহুতান,
মোয়াযযিনের কণ্ঠে কে ও তোমারি সে আহবান’
কবি জীবিত অবস্থায় যে আযানের সুললিত কণ্ঠে মুগ্ধ, তিনি মৃত্যুর পরেও তা শুনার জন্য আগ্রহী।
তাই তিনি বলেছেন ঃ
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মুয়াযযিনের আযান শুনতে পাই।’
ভেঙ্গে পড়া (সাবেক) সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে যে কম্যুনিজম কায়েম হয়, মুসলমানরা কিছুতেই সে কম্যুনিজমের সাথে নিজেদেরকে মিশিয়ে নিতে পারেনি। কম্যুনিষ্ট মসজিদ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন ঃ যদি আমার কাছে লোকেরা দৈনিক পাঁচবার হাজির হয়, তাহলে আমি গোটা দুনিয়াকে কম্যুনিষ্ট বানিয়ে দিতে পারবো। (দৈনিক ওকাজ, জেদ্দা, ১৯৯০)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মসজিদ ইবাদাত ও সকল সামাজিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
মসজিদ নববীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যাবেঃ
মসজিদে নববীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ঃÑ মহানবী (স:) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পথে কুবা নামক স্থানে প্রায় ২ সপ্তাহ অবস্থান করেন। তারপর মদীনা শহরের অভ্যন্তরে পৌঁছার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে বনী সালেম পল্লীতে শুক্রবারে জুময়ার সলাত পড়েন এবং জুময়া শেষে তিনি রওনা করেন। তাঁর উট মসজিদে নববীর বর্তমান স্থানে এসে বসে পড়ে। এই স্থানটি ছিল খেজুর শুকানোর স্থান ও উটÑবকরীর আস্তাবল। ২ জন ইয়াতীম শিশু ছিল ঐ জায়গার মালিক। রসূলুল্লাহ (স:) ১০টি সোনার দীনারের বিনিময়ে ঐ সম্পত্তি কিনেন এবং হযরত আবু বকরকে মূল্য পরিশোধ করার আদেশ দেন। ঐ যমীনে খেজুর গাছ ও মুশরিকদের কবর ছিল এবং এক অংশ ছিল নীচু। তাতে বৃষ্টির পানি জমে থাকত। তিনি খেজুর গাছ কেটে ফেলেন এবং কবরের হাড়-গোড় বের করে অন্যত্র পুঁতে ফেলার নির্দেশ দেন। নিুাংশ ভরাট করেন। ১২ দিন পর্যন্ত তিনি খালি স্থানে নামায পড়েন। তারপর মসজিদ তৈরী করেন। তিনি এবং মোহাজের, আনসার ও সাহাবায়ে কেরাম মিলে মসজিদ তৈরী করেন। আম্মার বিন ইয়াসার (রা:) ছিলেন মসজিদের প্রধান রাজমিস্ত্রী ও নির্মান কৌশলী। রসূলুল্লাহ (স:) স্বয়ং নিজেও সাহাবায়ে কেরামের সাথে ইটÑপাথর বহন করেন। তিনি নিজহাতে একটি পাথর দিয়ে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। মসজিদের ভিত্তিতে পাথর, দেয়ালে ইট, চালে খেজুর পাতা ও সুঘ্রাণ এজখের ঘাস এবং খুঁটিতে খেজুর গাছ ব্যবহার করা হয়। চালের ওপর কাদা মাটির প্রলেপ দেয়া হয় ঠাণ্ডার জন্য। একবার বৃষ্টির পানিতে মসজিদের মেঝে কর্দমাক্ত হয়ে যায়। স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স:)এর কপাল ও দাঁড়িতে কাদা লাগে। সাহাবায়ে কেরাম মেঝেতে পাথরের নুড়ি ঢেলে দেন। ১ম হিজরী সনে নির্মিত মসজিদের আয়তন ছিল ৭০ঢ৬০ গজ বা ৮৫০.৫ বর্গমিটার। উচ্চতা ছিল ২.৯ মিটার।
* ৭ম হিজরীতে খায়বার বিজয়ের পর ক্রমবর্ধমান মুসল্লীর সংকুলানের জন্য মসজিদকে সম্প্রসারিত করা হয়।এখন এর আয়তন দাঁড়ায় ১০০ঢ ১০০ গজ অর্থাৎ ২০২৫ বর্গমিটার এবং ছাদ ৭ গজ উঁচু করা হয়। রসূলুল্লাহ (স:) এর সময়ের মসজিদের সীমানা এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। এ সময় মসজিদের ৩টি দরজা ছিল।
* মসজিদের ভিতর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে, রাওদাহ বা ‘বেহেশতের বাগান’ নামক জায়গাটি। রাওদাহর দৈর্ঘ ২২ মিটার ও প্রস্থ ১৫ মিটার। রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, “আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান হচ্ছে বেহেশতের বাগান।” (বুখারী, মুসলিম) এই জায়গায় ইবাদাত ও এতেকাফের ফযীলত ও সওয়াব অনেক বেশী।
* বিভিন্ন সময় মসজিদে নববীর সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। যারা সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেছেন, তাঁরা হলেন, (১) রসূলুল্লাহ (স:), (২) ওমর (রা:), (৩) ওসমান (রা:), (৪) ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালেক, (৫) খলীফা মাহদী, (৬) আশরাফ কায়েতবায়, (৭) সুলতান আব্দুল মজীদ, (৮) বাদশাহ আব্দুল আযীয, (৯) বাদশাহ ফয়সল বিন আব্দুল আযীয, (১০) বাদশাহ খালেদ বিন আব্দুল আযীয এবং (১১) বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আযীয।
* বর্তমানে মসজিদের আয়তন হচ্ছে, ৯৮ হাজার ৫শ বর্গমিটার। মসজিদের ভেতর ১ লাখ ৬৭ হাজার মুসল্লী , ছাদের ওপর ৯০ হাজার মুসল্লী এবং আঙ্গিনায় মোট ২ লাখ ৫০ হাজার মুসল্লী একই সময়ে নামায পড়তে পারে। সব মিলিয়ে একই সময় সাড়ে ৬ লাখ লোক একসাথে নামায পড়তে পারে। মসজিদে কেন্দ্রীয় এয়ার কন্ডিশনের ব্যবস্থা আছে। ফলে, গরমের সময় মুসল্লীরা ঠাণ্ডা অনুভব করে। এতে ১০ টি মিনারা ও ২৭ টি গম্বুজ আছে। এতে ৭টি প্রবেশ পথ ও ৮২ টি দরজা আছে।
* হুজরাহ মোবারকেই তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক শায়িত আছেন। তাঁর কবরটি লোহার জালি দ্বারা আবৃত এবং কবরের চার পার্শ্বে শীশা ঢালাই করে কবর মজবুত করা হয়েছে। দু®কৃতিকরীরা কয়েকবার লাশ মোবারক চুরির উদ্যোগ নেয়ায় ঐ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
* পার্শ্বেই রয়েছে তাঁর দুই সাথীর কবর। তাঁরা হলেন হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা:)। ৪র্থ কবরের স্থানটি আজ পর্যন্ত খালি পড়ে আছে।
মসজিদে নববীর গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমসমূহ
১. জামায়াতে সলাত আদায় ঃÑ নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সলাত জামায়াত সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। এতে নারী পুরুষ সবাই অংশ গ্রহণ করত।
২. দ্বীনের কাজে সার্বক্ষনিক সময়দানকারী সাহাবাদের বাসস্থল ঃÑ ইহা ছিল মসজিদের উত্তর কোণে। তাদেরকে বলা হত আসহাবে সুফফা। সার্বক্ষনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আসহাবে সুফফার ভূমিকা ছিল মুখ্য।
৩. রসূলের (স:) ইসলামী আন্দোলনের অফিস ঃÑ রসূল (স:) অহী প্রাপ্তির পর আল্লাহ তা’য়ালার দেয়া
বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য হিজরতের পর থেকে সার্বক্ষণিক অফিস হিসেবে মসজিদে নববীকে ব্যবহার করেছেন।
পরামর্শ, সিদ্ধান্ত, বাস্তবায়ন, কাফেলা প্রেরণ, গ্র“প বন্টন এক কথাই সাংগঠনিক যাবতীয় কর্মকান্ড মসজিদে
নববী কেন্দ্রীক পরিচালিত হতো। অথচ আমাদের সমাজে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে “মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা হারাম।”
৪. মুসলিম উম্মাহর সভাকক্ষ ও পরামর্শ সভাÑ বর্তমানে যুগের পার্লামেন্ট বা বিধান সভা বলা হয়।
* রসূলুল্লাহ (স:) মসজিদে নববীকে ‘দারে নাদওয়া’ বা শলা-পরামর্শের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি
মুসলমানদের সাথে মসজিদে দীন ও দুনিয়ার সকল বিষয়ে এবং বিশেষ করে যুদ্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে পরামর্শ করতেন। আমরা দেখতে পাই, তিনি মসজিদে নববী থেকেই বদর যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি মসজিদে আনসার ও মোহাজেরদেরকে ডাকেন এবং মক্কার আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়া থেকে মক্কাগামী বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণের প্রস্তাব দেন।
* বদর যুদ্ধে ৩১৩ জনের মুসলিম বাহিনী ১ হাজার কোরাইশ বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করে এবং কাফেরদের মনে ভীতি সঞ্চার করে। আল্লাহ মু’মিনদেরকে সাহায্য করে নিজ ওয়াদা পূরণ করেছেন। মসজিদ থেকেই যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। তাই এ বিজয়ও বরকতময়।
বদর যুদ্ধের পরাজিত হওয়ার পর মক্কার কোরাইশরা এর প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে পরের বছর ওহোদ যুদ্ধের
জন্য মদীনায় আগমন করে। রসূলুল্লাহ (স:) কোরাইশ বাহিনীর মোকাবিলার উপায় নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে মসজিদে নববীতে এক বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকে যে বিষয়টি সর্বাধিক আলোচিত হয়, সেটি হল, মুসলমানরা মদীনা শহরের ভিতর থেকে প্রতিরক্ষার কাজ করবে, না শহরের বাইরে যাবে।
দীর্ঘ শলাÑপরামর্শ ও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, মুসলিম বাহিনী শহরের বাইরে যাবেন। বিশেষ করে তারা
ওহোদ প্রান্তরে যাবেন। বদর যুদ্ধে যে সকল যুবক অংশগ্রহণ করে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেনি, তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রসূলুল্লাহ (স:) শহরের বাইরে ওহোদ প্রান্তরে যেতে রাজী হলেন। যদিও তিনি প্রথম দিকে শহরের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। মোনাফেক সরদার আবদুল্লা বিন উবাই বিন সালুলও বাইরে যেতে প্রস্তুত ছিল না।
এ প্রসঙ্গে ইবনে হেশাম তার সীরাত গ্রন্থে লিখেন, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, “আল্লাহর শপথ! আমি ভাল স্বপ্ন
দেখেছি। আমি স্বপ্নে দেখেছি, একটি গরু জবেহ করা হয়েছে, আমি আমার তলোয়ারকে ভোতাঁ দেখেছি এবং আরো দেখেছি যে, আমি আমার হাত সুরক্ষিত লৌহবর্মের ভিতর ঢুকিয়েছি। আমি একে মদীনা শহর বলে ব্যাখ্যা করেছি। তোমরা যদি চাও মদীনা শহরে অবস্থান কর এবং তাদেরকে তাদের অবতরণ স্থলে থাকতে দাও। তারা যদি অবস্থান করে তাহলে, নিকৃষ্ট স্থানেই অবস্থান করবে এবং যদি তারা আমাদের শহরে প্রবেশ করে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো।”
এ দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, রসূলুল্লাহ (স:) মদীনার বাইরে যাওয়াটাকে পছন্দ করেননি। তারপরও
মুসলমানদের পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ওহোদ প্রান্তরে বেরিয়ে যান। সেখানে কাফের বাহিনীর সাথে মুসলমানদের বিরাট যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে আছে।
রসূলুল্লাহ (স:) মসজিদে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানাতেন। প্রতিনিধিরা মসজিদের পার্শ্বে সওয়ারী বেঁধে মসজিদের খোলা অংশে রসূলুল্লাহ (স:) এর সাথে সাক্ষাত করতেন। সম্ভবত মদীনায় পৌঁছে সর্ব প্রথম মসজিদ তৈরীর এটাই প্রধান কারণ। ঐ মসজিদের উদ্দেশ্য শুধু ইবাদাত ও নামায পড়াই নয় বরং তার উদ্দেশ্য আরো ব্যাপক এবং তাতে রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য।
ইসলামের প্রথম যুগে মসজিদকে বর্তমান যুগের পার্লামেন্টের সাথে তুলনা করা যায়। এর উত্তম উদাহরণ হল,
মক্কা বিজয়ের পর কা’বার দরজায় দাঁড়িয়ে রসূলুল্লাহ (স:) মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি ইসলামের কিছু মূলনীতি ঘোষণা করেন এবং বিজিত মক্কাবাসীর কাছে তাদের বিষয়ে কি ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া যায় সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। তারা ক্ষমা সুন্দর ভুমিকার আহ্বান জানায়। রসূলুল্লাহ (স:) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।
৫. ইসলামী রাষ্ট্রের রাজপ্রাসাদ ঃÑ মসজিদে নববীতেই নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের আইনকানুন প্রতি পালিত হয়েছে। পরবর্তিতে গোটা দুনিয়ায় তা ছড়িয়ে পড়েছে।
৬. ইসলামে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঃÑ মসজিদে নববী ছিল ইসলামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। সাহাবায়ে কেরামগন ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য ছাত্র।
স্বভাবতই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সকলের জ্ঞানগত যোগ্যতা সমান ছিল না। তাঁরা নির্বিশেষে ইলেম, হেদায়াত, ফযীলত ও শিষ্টাচার অর্জন করেছেন। তবে সবার সুযোগও সমান ছিল না। অনেকেই ছিলেন অভাবগ্রস্থ। ফলে, জীবিকার দাবী মেটাতে গিয়ে সবাই জ্ঞান আহরণে সমান সময় দিতে সক্ষম ছিলেন না। অথচ, প্রত্যেক সাহাবীই সাধ্যনুযায়ী মসজিদে নববীতে হাযির হওয়ার চেষ্টা করতেন এবং যারপর নেই যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। এমনকি হযরত ওমর (রা:) তাঁর প্রতিবেশীর সাথে পালাক্রমে মসজিদে নববীতে আসতেন এবং ঐ দিনের আলোচনা পরস্পর পরস্পর থেকে জেনে নিতেন। এভাবে তাঁরা মসজিদে নববীর মহান শিক্ষকের শিক্ষাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন।
এ বিষয়ে বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে হযরত ওমর (রা:) বলেন :
“আমি এবং আমার আনসার প্রতিবেশী রসূলুল্লাহ (স:) এর কাছে পালাক্রমে যেতাম। তিনি একদিন এবং আমি
অপরদিন যেতাম। আমি যেদিন যেতাম সেদিনের খবর প্রতিবেশীকে জানাতাম এবং তিনি যেদিন যেতেন, সেদিনের খবর তিনি আমাকে জানাতেন।” (বুখারী, ইলম অধ্যায়)
মসজিদে নববী থেকে প্রখ্যাত ওলামায়ে কেরাম ও সুগস্রষ্টা মনীষী তৈরী হয়েছেন। আরো তৈরী হয়েছেন ফকীহ
ও মোহাদ্দিস। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ, আবদুল্লাহ বিন ওমর, ইমাম আবু হানীফা, মালেক বিন আনাস, মুহাম্মাদ, শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল, বুখারী ও মুসলিমের মত প্রথিতযশা প্রদীপ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূর্য। তাঁদের জ্ঞান সাগরে ডুব দিয়ে কত লোক ঝিনুক কুড়িয়েছে এবং তাদের সাহিত্য ও চরিত্র এবং প্রজ্ঞা থেকে কতলোক সিন্ধু সেঁচে মুক্তা পেয়েছে।
পরবর্তীতে মদীনার মসজিদে নববীতে ইমাম মালেক বিন আনাস, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরিস শাফেঈ (র:)
মিসরের ফোস্তাত জামে মসজিদে, কুফা ও বাগদাদের মসজিদে ইমাম আবু হানীফা নোমান এবং বাগদাদের মসজিদে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এটাতো গেল ফিকাহ শাস্ত্র।
হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণও মসজিদ ভিত্তিক গবেষণা, সংগ্রহ ও শিক্ষাদানে ব্যস্ত ছিলেন। এসহাক বিন রাহ্ওয়াই,
ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ মসজিদেই হাদীস শাস্ত্রের সেবা আঞ্জাম দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে, প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক জাহেজসহ আরো অগণিত সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী পণ্ডিতেরা মসজিদেই
লেখা-পড়া করেছেন। বর্তমান যুগের প্রসিদ্ধ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁরা বের হননি।
আমাদের কতই না সৌভাগ্য! ইবাদতের জন্য মসজিদে ঢুকে আত্মার পবিত্রতা অর্জনের সাথে সাথে দীন ও দুনিয়ার জন্য চলার উপযোগী জ্ঞান নিয়ে আমরা বের হয়ে আসতে পারি।
রাসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন ঃ
“যে আমাদের এ মসজিদে কিছু ভাল জিনিস শিখতে কিংবা শিখাতে আসে, সে যেন আল্লাহর পথের মোজাহিদ।
আর যে এটা ব্যতীত মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন এমন জিনিসের দর্শক যা তার জন্য নেই।”
রাসূলুল্লাহ (স:) জোর দিয়ে বলেছেন ঃ
“ব্যক্তি যে সময় পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করে সে সময় পর্যন্ত আলেম বা জ্ঞানী থাকে। যখন সে ধারণা করে যে, শিখে
ফেলেছে, তখনই সে অজ্ঞ-মুর্খের কাতারে নাম লেখায়।
৭. আদর্শ ইসলামী পাঠাগার ঃÑ মসজিদে নববী পাঠাগার হিসেবেও ব্যবহার হয়েছে। দীনী বই-পুস্তকসমূহ
মসজিদে রেখে পাঠকদের চাহিদা পূরণ করা হত। সাধারণত ধনী ও জ্ঞানী-গুণী লোকেরা মসজিদে কিতাব-পত্র ও বই-পুস্তক দান করতেন। পরবর্তীতে দেখা গেছে খতীব বাগদাদী নিজ কিতাবসমূহ মসজিদে ওয়াকফ করে গেছেন এবং মৃত্যুর আগে তা নিজ বন্ধু আবুল ফদ্বল বিন খাইরুনের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। এ ছাড়া আবদুল্লাহ বিন আহমদ আল-মা’রুফ বিন খাশ্শাবসহ আরো অনেকে নিজ কিতাবসমূহ মসজিদে ওয়াকফ করে গেছেন।
৮. সমাজসেবা ও আশ্রয়কেন্দ্র ঃÑ মসজিদ মুসলমানের জীবনে বিপদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায়
আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। বিপদগ্রস্থ লোকেরা দলে দলে কিংবা একাকী মসজিদে দৌড়ে আসে ও আশ্রয় নেয়। সেই কঠিন মুহূর্তে মুসলিম দায়িত্বশীলরা সেখানে একত্রিত হয়ে দুর্যোগের মোকাবিলার উপায় বের করেন।
মসজিদের সামাজিক ভূমিকা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইবনে জোবায়ের এবং ইবনে বতুতার মত বিশ্ব পর্যটকের মন্তব্য ও বক্তব্য থেকে। তাঁরা যখনই কোন নতুন দেশে গিয়েছেন, যেখানে কোন পরিচিত লোকজন নেই, সেখানেই তাঁরা প্রথমে মসজিদে হাযির হয়েছেন। মসজিদে স্থানীয় কিংবা প্রবাসী লোকজনের সাথে পরিচিত হওয়ার পর তাদের থাকা-খাওয়ার আর কোন সমস্যা হয়নি। স্থানীয় লোকেরা পর্যটক আলেমের সন্ধান পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং কোন কোন সময় তাদের যোগ্যতা ও মর্যাদা মোতাবেক উপযুক্ত কাজে যোগদানেরও আহ্বান জানান।
৯. আদালত (কোর্ট)ঃÑ * মসজিদ আদালতের ভুমিকা পালন করে। মসজিদের বিছানা ও খুটির মাঝ থেকে
বিচারকের এমন ইনসাফপূর্ণ রায় ঘোষিত হয়েছে যা গোটা মানবতার বিচারের ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা আছে। মসজিদে বসেই বিচারক উটের রাখালের পক্ষে ও আব্বাসী খলীফা মানসুরের বিরুদ্ধে ইনসাফপূর্ণ রায় ঘোষণা করেছিলেন। বিচারক খলীফার বিরুদ্ধে দরিদ্র-অসহায়-দিনমজুরের পক্ষে রায় ঘোষণা করতে কোন পরোয়া করেননি।
* রসূলুল্লাহ (স:) মসজিদে ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং বিভিন্ন দন্ডবিধি ও শাস্তি কার্যকর করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, যেন ধনী-গরীব, ছোট-বড়, শক্তিশালী ও দুর্বল সবাই ঐ ন্যায়-নীতি দেখে চরিত্র গঠন করতে পারে। মসজিদে অবস্থিত এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (স:) কে লক্ষ্য করে আহ্বান জানায়, হে আল্লাহর রসূল! আমি যেনা করেছি। রসূলুল্লাহ (স:) তাঁর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। তারপর সেই ব্যক্তি নিজের অপরাধের ব্যাপারে চারবার সাক্ষ্য দেয়ার পর রসূলুল্লাহ (স:) তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি পাগল’? লোকটি বলেন, ‘না’। তারপর তাকে প্রশ্ন করেন, তুমি কি বিয়ে করেছ ?’ সে জওয়াব দেয়, ‘হ্যাঁ’। তখন রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, ‘তাকে নিয়ে যাও এবং পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা কর।’
১০. সাহিত্যÑসংস্কৃতি কেন্দ্র ঃÑ মসজিদে বর্ণিত দীনী জ্ঞান চর্চাই সব কিছু ছিল না। বরং তা ছিল
সাহিত্যÑসংস্কৃতি চর্চারও উপযুক্ত ময়দান। তাতে যুদ্ধের বিজয় গাঁথাও গাওয়া হত। হযরত হাস্সান বিন সাবিত মসজিদে নববীতে কবিতা আবৃত্তি করতেন। কিন্তু রসূলুল্লাহ (স:) তাঁকে নিষেধ করেননি। যে গান বা কবিতায় আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রশংসা কিংবা ইসলামের প্রতিরক্ষার বিষয়বস্তু থাকবে, তা অবশ্যই উত্তম জিনিস। তাই রসূলুল্লাহ (স:) তাঁকে বারণ করেননি।
একদিন হযরত হাস্সান (রা:) কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। হযরত ওমর (রা:) মসজিদে তাঁর দিকে নজর দেন। তখন হাস্সান বলেন, ‘আমি এই মসজিদে আপনার চাইতে উত্তম ব্যক্তির উপস্থিতিতে কবিতা আবৃত্তি করেছি। তখন ওমর (রা:) চলে যান এবং বুঝতে পারেন যে, হাস্সান রসূলুল্লাহর (স:) প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
একদিন কা’ব বিন যোহাইর মসজিদে নববীতে রসূলুল্লাহ (স:) সহ সাহাবায়ে কেরামের সামনে ফজর বাদ ‘বানাত্ সোআদ’ নামক প্রখ্যাত আরবী কবিতাটি পাঠ করেন। অথচ, ইতিপূর্বে রসূলুল্লাহ (স:) তার বিরুদ্ধে মৃত্যু দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেছিলেন। তারপর নবী (স:) তার ওপর থেকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করেন এবং মৃত্যুদন্ডের বিনিময়ে ১শ উট দানের নির্দেশ দেন।
১১. হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয় ঃÑ মসজিদ হাসপাতাল হিসেবেও সেবা দান করে। ইসলামের ইতিহাসে
সংঘটিত যুদ্ধসমূহে মসজিদের একাংশকে যুদ্ধাহত মোজাহেদীনের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হত। এর উত্তম উদাহরণ হল; আহযাব যুদ্ধে আওস বংশের নেতা আহত সা’দ বিন মোআ’যকে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সেবার জন্য রসূলূল্লাহ (স:) মসজিদে একটি তাবু কায়েমের নির্দেশ দেন। (বুখারী-১ম খন্ড) সেখানে তাঁর চিকিৎসা করা হয়। আনসারী মহিলা সাহাবী রাফিদাহ (রা:) ঐ তাঁবুতে যুদ্ধাহত মুসলিম সেনাদের চিকিৎসা-সেবা আঞ্জাম দেন। সম্ভবত আহযাব যুদ্ধের বেশ আগেই তাঁবুটি মসজিদে নির্মিত হয়েছিল।
১২. অর্থভান্ডার ও বিতরণ কেন্দ্র ঃÑ মসজিদে নববীতে য্দ্ধুলব্ধ মালে গনীমত এবং সাদকাহ ও যাকাতের মাল
আসত। রসূলুল্লাহ (স:) সেগুলো অভাবী লোকদের মধ্যে বিলি করতেন এবং এতে যাদের অধিকার আছে, তাদেরকে তা দিতেন। তিনি ছিলেন সর্বাধিক দাতা। প্রতি রমযান মাসে জিবরীলের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি মুক্ত বাতাসের মত উন্মুক্ত দান শুরু করতেন। তিনি নিজের ভোগের অংশ যে কোন অভাবী লোককে চাওয়া মাত্র দিয়ে দিতেন। এ দৃষ্টিতে মসজিদে নববী ছিল অর্থভান্ডার ও বিতরণকেন্দ্র। পরবর্তীতেও প্রত্যেকটি মসজিদের ছিল নিজস্ব তহবিল। সেই তহবিল থেকে দান ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করা হত।
রসূলুল্লাহ (স:) যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি কায়েম করেন। এর ফলে, মসজিদে যাকাতের মাল-সম্পদ জমা হত। মসজিদ থেকেই যাকাতের অর্থ গরীব লোকদের মাঝে বন্টন করা হত। এ যাকাত পদ্ধতির কারণেই মুসলিম সমাজের অভাবী ও সর্বহারা লোকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় এবং খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীযের আমলে যাকাতের সংগৃহীত অর্থ বন্টনের জন্য কোন গরীব মুসলমানÑঅমুসলমান কাউকেই পাওয়া যায়নি। আল্লাহ ইসলামী অর্থনীতির বরকতে সমাজ থেকে দারিদ্র দূর করে দিয়েছেন।
আজও মসজিদের এ ধরনের তহবিল থাকলে অভাব ও দারিদ্র দূর করে বহু সামাজিক সেবা আঞ্জাম দেয়া সম্ভব।
১৩. রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ঃÑ মসজিদে নববীই ছিল রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম। সকল রাজকীয় ঘোষণা মসজিদ নববীর
মিম্বর থেকেই জারী হত। পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদাও তাই করেছেন।
* হযরত আবু বকর (রা) খলীফা হওয়ার পর মসজিদে নববীতে বাইআতের জন্য যান এবং তিনি যে নীতি অনুসরণ করবেন সে সম্পর্কে ভাষণ দেন। বাইআত শেষে তিনি মিম্বারে ওঠেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন। তারপর বলেন, “হে লোকেরা! আমি তোমাদের খলীফা নির্বাচিত হয়েছি অথচ আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম ব্যক্তি নই। যদি আমি ভাল কাজ করি আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি খারাপ কাজ করি তাহলে আমাকে সোজা করে দেবে। সত্যবাদিতা আমানত এবং মিথ্যা হচ্ছে খেয়ানত। তোমাদের দুর্বল ব্যক্তিও আমার কাছে সবল যে পর্যন্ত না আমি তার অধিকার তাকে ফিরিয়ে দেই। তোমাদের সবল ব্যক্তিও আমার কাছে দুর্বল যে পর্যন্ত না আমি তার কাছ থেকে অন্যের অধিকার কেড়ে আনি। তোমাদের কেউ আল্লাহর পথে জিহাদ ত্যাগ করতে পারবে না। কোন জাতি জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাদের ওপর বিপদ নাযিল করেন। তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আমার আনুগত্য কর যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করি। আমি যদি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করি, তাহলে তোমাদের ওপর আমার কোন আনুগত্য নেই। তোমরা নামাযের জন্য দাঁড়াও।”
* হযরত ওমর (রা:) খেলাফত লাভ করার পর মসজিদে নববীর মিম্বারে ওঠেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া
আদায় করে বলেন, “ হে লোকেরা! আমি আল্লাহর কাছে দোয়া জানাচ্ছি, তোমরা আমীন বল। হে, আল্লাহ! আমি কঠোর, আমাকে তোমার আনুগত্যকারীদের প্রতি বিনম্র করে দাও, আমি যেন সত্যের অনুসরণ, তোমার সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তির ভিত্তিতে তাদের সাথে নরম ব্যবহার করতে পারি, আমাকে তোমার দুশমন ও মোনাফেকের প্রতি কঠোর হওয়ার তওফীক দান কর, আমি যেন তাদের ওপর কোন যুলুম ও অন্যায় না করি। হে আল্লাহ! আমি কৃপণ, আমাকে অপচয়, সুনাম ও লোক দেখানোর অন্যায় থেকে বাঁচিয়ে নেক কাজের দাতা বানিয়ে দাও। আমি যেন এর মাধ্যমে তোমার সন্তুষ্টি ও আখেরাতে মুক্তি লাভ করতে পারি। হে আল্লাহ! আমি যেন মু’মিনদের জন্য বাহু নীচু করতে পারি এবং তাদের প্রতি নরম হতে পারি। হে আল্লাহ! আমি বেশী উদাসীন ও বেশী ভূল করি, আমাকে প্রতি মুহূর্তে তোমার যিকর করার তওফীক দাও এবং সর্বদা মৃত্যুকে স্মরণ করার যোগ্যতা দাও। হে আল্লাহ! আমি আমার অনুগত আমলের ক্ষেত্রে দুর্বল, আমাকে সেক্ষেত্রে কর্মতৎপর করে দাও এবং নেক নিয়ত সহকারে শক্তি দাও। তোমার সাহায্য ও তওফীক ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। হে আল্লাহ! আমাকে দৃঢ় বিশ্বাস বা ইয়াকীন, নেক কাজ ও তাকওয়ার তওফীক দান কর এবং তোমার সামনে উপস্থিত হওয়ার কথা ও লজ্জা পাওয়ার ব্যথা স্মরণ করিয়ে দিও। তুমি যে কাজে সন্তুষ্ট থাক সে কাজে আমাকে বিনয় দান করে, নিজের আত্ম-সমালোচনা ও সংশোধনের সুযোগ দাও এবং সন্দেহ থেকে বাঁচিয়ে রাখ। হে আল্লাহ! আমার জিহ্বা থেকে তোমার কিতাবের যে সকল কথা উচ্চারিত হয় সেগুলোর প্রতি আমল ও চিন্তা-গবেষণা করার তওফীক দাও। তুমি সকল বিষয়ের ওপর সর্বশক্তিমান।
* হযরত ওমর (রা:) আরেক দিন মসজিদে নববীতে এক ভাষণে বলেন ঃ “হে লোকেরা! আমি তোমাদেরকে মারার জন্য কিংবা তোমাদের সম্পদ নেয়ার জন্য কোন কর্মচারী পাঠাই না। আমি তাদেরকে পাঠাই তোমাদের দীন ও নবীর সুন্নাত শিক্ষা দেয়ার জন্য। কোন কর্মকর্তা যদি এর বাইরে কোন কাজ করে সে ব্যাপারে আমার কাছে যেন অভিযোগ করা হয়, আল্লাহর কসম, আমি এর প্রতিশোধ নেবো। তখন আমর বিন আস লাফ দিয়ে হাযির হন এবং জিজ্ঞেস করেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনার কোন কর্মচারী যদি প্রজা সাধারণকে আদব শিক্ষার উদ্দেশ্যে মারে তাহলেও কি আপনি এর প্রতিশোধ নেবেন ? ওমর (রা:) বলেন ঃ আল্লাহর কসম, আমি বদলা নেবো। কেননা; আমি রসূলুল্লাহ (স:) কেও অনুরূপ ক্ষেত্রে প্রতিশোধ নিতে দেখেছি। সাবধান! তোমরা মুসলমানদেরকে মেরে লাঞ্ছিত করো না এবং তাদেরকে ধ্বংস করো না।”
* পারস্য বিজয়ের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় তিনি মুসলমানদেরকে মসজিদে নামাযের জন্য আহ্বান
করেন। ইতিমধ্যে তিনি বুদ্ধিজীবী মহলের সাথে এ বিষয়ে শলা-পরামর্শ শেষ করেন। তারপর মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে তিনি বলেন ঃ “আল্লাহ মুসলমানদেরকে দীন ইসলামের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তিনি তাদের অন্তরকে জোড়া দিয়েছে, তাদেরকে ভাই হিসেবে আপন করে দিয়েছেন। মুসলমানরা একই দেহের মত। তাদের একজনের শরীর ব্যথা হলে অন্যরাও সে ব্যথা অনুভব করবে। মুসলমানদের সকল বিষয় পরামর্শের ভিত্তিতে সংঘটিত হবে। মুসলিম
চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ দিতে হবে। অন্যদের সে ঐক্যবদ্ধ পরামর্শ অনুসরণ করা জরুরী।”
* একবার মু’আবিয়া বিন আবি সুফিয়ান (রা:) মদীনায় আসেন এবং মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে মিম্বারে উঠে
একটি ভাষণ দেন। পরবর্তী আরেক সময়ে তিনি মদীনায় আসেন এবং পুনরায় মসজিদে প্রবেশ করে ভাষণ দেন। উভয় ভাষণে তিনি তাঁর সরকারের ভবিষ্যত নীতি নির্ধারণী বক্তব্য পেশ করেন। তিনি মদীনাবাসীকে তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের আহ্বান জানান।
১৪. সামরিক ঘাঁটি (ক্যান্টনমেন্ট) ঃÑ * মূলত ‘মসজিদ একটি প্রশিক্ষণ শিবির। কিসের প্রশিক্ষণ শিবির? নিয়ম-নীতি
ও শৃংখলার প্রশিক্ষণ শিবির। সময়ের নিয়মানুবর্তিতা ও এর মূল্য বুঝা এবং ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করার জন্য আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সলাত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। নির্ধারিত সলাত সমূহের জন্য মসজিদে জামায়াতের সুনির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সে সময় অনুযায়ী দিনে পাঁচ বার মসজিদে হাযির হতে হয়।
এরপর রয়েছে, সোজা ও সমানভাবে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো। কাতার সোজ না হলে গুনাহ হয় এবং নামায অসম্পূর্ণ থাকে।
* নব্য উপনিবেশবাদী কিংবা সাম্রাজ্যবাদীরা কোন দেশ জয় করে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে নিজেদের পতাকা
উত্তোলন করে। পক্ষান্তরে, মুসলনমানরা বিজয়ের পর মসজিদ তৈরী করে প্রমাণ করে যে, এটি ইসলামী রাষ্ট্রের অংশ হয়ে গেছে। মসজিদ তৈরীর অন্য উদ্দেশ্য হল, সংশ্লিষ্ট যমীনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা, বিজিতের ওপর বিজয়ীর সার্বভৌমত্ব নয়। কুবা ও মদীনায় পৌঁছে রসূলুল্লাহ (স:) সর্বপ্রথম ঐ মসজিদ দু’টো তৈরী করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বই ঘোষণা করেছিলেন। আমরা আরো দেখতে পাই কুফা, ফোস্তাত ও কায়রাওয়ানে বিজয়ী মুসলমানরা নিজেদের গর্ব-অহংকারের কথা বাদ দিয়ে জুমআর খোতবায় শুধুমাত্র আল্লাহ শুকরিয়া ও প্রশংসা আদায় করেছেন।
* মুসলমানদের জীবনে মসজিদ সামরিক কেন্দ্র ছিল। রসূলুল্লাহ (স:) মসজিদ থেকে জিহাদের উদ্দেশ্যে
সেনাবাহিনী পাঠানো ছাড়াও ইসলামে গ্রহনেচ্ছু প্রতিনিধিদলকে মসজিদেই স্বাগত জানান। এর উত্তম উদাহরণ হল, ৯ম হিজরীর তাবুক যুদ্ধের পর রসূলুল্লাহ (স:) সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিবৃন্দের উদ্দেশ্যে নববীতে তাঁবু তৈরী করেন। উদ্দেশ্য ছিল, তারা যেন মসজিদে কুরআন শুনে, মুসল্লীদেরকে নামায পড়তে দেখে এবং তাদের আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
১৫. কারাগার (বন্দীশালা) ঃÑ মহানবী (স:) যুদ্ধবন্দীদেরকে মসজিদে বেঁধে রাখতেন। এ ক্ষেত্রে সামামাহ বিন আসালের উদাহরণ দেয়া যায়। বন্দী অবস্থায় আসার পর রসূলুল্লাহ (স:) তাঁকে চিনতে পেরে মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখার নির্দেশ দেন। এবং তার সাথে ভাল ব্যবহারের আদেশ দান করেন। যদিও সবার সাথেই ভাল ব্যবহার করা হত। রসূলুল্লাহ (স:) তার কাছে তিনদিন পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন কিন্তু সামামাহ ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। তারপর রসূলুল্লাহ (স:) তাঁকে মুক্তিদানে নির্দেশ দেন। মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তিনি গোসল করেন এবং নবী করীম (স:) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। (বুখারী, কিতাবুস সলাত:১ম খন্ড)
ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাসে ঐ ঘটনার সুদূর প্রসারী প্রভাব রয়েছে। নৈতিক প্রশিক্ষণ ও ইসলামী সংস্কৃতি
বিস্তারের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি। মসজিদ আল্লাহর সঠিক পরিচয় ও অন্তর থেকে অন্ধকার দুর করার উদ্দেশ্যে আলো বিকিরণের স্থান।
রসূলুল্লাহ (স:) মসজিদের আঙ্গিনাকে সেনাবাহিনীর সমাবেশ এবং তাদের নেতা নির্বাচনের জন্য ব্যবহার করতেন।
১৬. দৈনন্দিন তালিম ও সাপ্তাহিক খুতবাহ ঃÑ
প্রত্যহ ফজর ও আছরের সলাতের পর মহানবী (সঃ) উপস্থিত মুসল্লীদেরকে দ্বীনি তালিম ব্যবহারিক শিক্ষাসহ
নানামুখি হেদায়েত দিতেন এবং আর্থÑসামাজিক সার্বিক বিষয়ের উপর সাপ্তাহিক জুময়ার খুতবাহতে মুসল্লিদেরকে সচেতন করে তুলতেন। পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদাসহ সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এবং খলীফা ও মুসলিম উম্মাহর খতীবগণ একই পদ্ধতিতে মসজিদে মসজিদে এ তা’লিম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু রাখেন।
আলোচ্য বিবরণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের সোনালী যুগে মসজিদ সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর দায়িত্বশীলগণের অমনোযোগিতা ও দুর্বলতার সুযোগে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোকে মসজিদ সমূহ তার মূল অবস্থান থেকে সরে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের মসজিদ সমূহের পরিণতি আরো করুণ আকার ধারণ করে। ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে মসজিদ পরিচালিত না হয়ে সাধারণ মানুষের নেতৃত্বেই মসজিদ পরিচালিত হয়। কোন কোন স্থানে ইমাম সাহেব মসজিদ কমিটির অনুগ্রহের পাত্র বলে বিবেচিত হয়Ñতাদের ইশারাতেই ইমাম সাহেবকে চলতে হয়। স্বাধীনভাবে কথা বলা – খুতবাহ প্রদান করার স্বাধীনতা টুকুও থাকে না। ইমাম নিয়োগের ব্যাপারে কোন সার্ভিস রূল নেই। যার কারণে ইমামগণ তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক বিধানের বিশ্লেষণ, হকের দাওয়াত এবং ইকামাতে দ্বীনের প্রতি আহ্বান তথা সঠিক দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকা পালন করতে গেলে ইমাম সাহেবকে কমিটির রোষানলে পড়তে হয়।