সীমান্তে বাংলাদেশীদের মৃত্যু ও কিছু কথা!
ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান
ওরা মানুষ নয়! ওরা ফেলানী! হায় ফেলানী! ফেলানী মরে গেছে ৭ই জানুয়ারী ২০১১ইং। ফেলানীদের মরতেই হয়। ফেলানীদের মৃত্যের কোন বিচার নেই।
বাঁচার অধিকার, নারী অধিকার ও শিশু অধিকার অত্যন্ত মৌলিক অধিকার মানুষের বাঁচার অধিকার বিশ্বে মোটামুটি সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌছে যাওয়ার পর নারী ও শিশু নিয়ে বর্তমানে সবাই কাজ করছে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, জনসংখ্যা, সামাজিক প্রতিটি বিভাগেই দুর্ভাগ্য। তার চেয়েও দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষ তার চেয়েও অভাগা দরিদ্র জনগোষ্ঠি এবং স্বাভাবিক ভাবেই নারী ও শিশুই সকল নির্যাতনের প্রধান শিকার।====ভারতের কোচবিহার জেলার সোনারি বিএসএফ ক্যাম্পে অবস্থিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীটির নিজস্ব আদালত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়। বিচারে ফেলানীকে সরাসরি গুলি করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত বিএসএফ-এর ১৮১ নং বাহিনীর সদস্য কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে বেকসুর নির্দোষ ঘোষণা করে …….. বা জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টে এবং ৫ সেপ্টেম্বর তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
৪০৯৫ কি:মি: সীমান্ত এলাকা আছে আমাদের ভারতের সাথে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো চরম দারিদ্রতার শিকার। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে পরিস্থিতি, সে সব এলাকায় তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। তারই কারণে সেসব এলাকার মানুষ ভারতে যায় সাময়িক ও নিু আয়ের কাজের খোঁজে। দারিদ্রতার আঘাতে সভ্যতার প্রায় সকল উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত মানুষগুলো কোন বৈধ কাগজপত্র জোগাড় করে যায় না। তারা বি,এস,এফ ও বি,জি,বি’র সাথে ঘুষের সম্পর্কে জড়িত কিছু দালালের সাথে যোগাযোগ করে টাকা দিয়ে সীমানা পাড়ি দেয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো অবশ্য টাকা নিয়ে নিজেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধনে তাদের পার করেনা। তার মানে দারিদ্র মানুষগুলো সম্পূর্ন অবৈধ অবস্থায় বিপদজনক ভাবে সীমানা পাড়ি দেয়। তবে ভারত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের ফেনসিডিল নামক মাদক দ্রব্য কিন্তু একই অবৈধ পথে তবে নিরাপদেই সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
তেমনিই শুক্রবার ভোরে নয়াদিল্লীর এক ইটের ভাটায় কাজ করা পরিবারের বাবা ও মেয়ে সীমানা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল। কিন্তু তারা কোন দালালের মাধ্যমে না এসে হয়তো নিজেদের উপর আস্থায় অথবা টাকা বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই প্রস্তুত মই বেঁয়ে চুঁপিচুঁপি সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গানোর সিদ্ধান্ত নেয়। শনিবার দিন মেয়েটির বিয়ে নির্ধরিত ছিল তাই টাকা ও গয়নাগাঁটি নিয়ে তার বাবার হাত ধরে কাঁটাতারে উঠে। বি,এস,এফ এর ভয় ও তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মেয়েটি জামা-কাপড় সহ সীমান্ত কাঁটাতারে আটকে যায় তৎক্ষনিক আতংক ও ভয়ে তার গলা দিয়ে বের হওয়া চিৎকার শুনে বি.এস.এফ দূর থেকেই তারে ঝুলে থাকা অবস্থায় মেয়েটিকে গুলি করে, তার বাবা নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে বেঁচে যায়। (সূত্র: প্রথম আলো)
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেয়েটি ৪ ঘন্টা কাঁটাতারে ঝুলেছিল। সকাল ১০টায় বি.এস.এফ তার মৃত লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় এবং ৩০ ঘন্টা পর পতাকা বৈঠক করে বি.জি.বির মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে লাশ ফেরৎ দেয়। (সূত্র: প্রথম আলো)
মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর, তার মৃত্যুতে হয়তো একটি বাল্য বিবাহ যা নারী নির্যাতন আইনে দন্ডনীয় তা রোধ হল কিন্তু নাানী ও শিশু হত্যার মত জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেল। বি.এস.এফ এর গুলিতে গত বছরের ৭০জন বাংলাদেশির নামের সাথে এ বছরের প্রথম ২ সপ্তাহে যোগ হল অন্তত ৩জন। যাদের মাঝে এই বাচ্চা মেয়েটিও যার চোখে কোন দিন কোন স্বপ্ন ছিলনা কিনা জানিনা তবে আমাদের অনেকের মত জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণনা হয়তো ছিল না। কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশের ছবি এসেছে আনন্দবাজার পত্রিকায়। (সূত্র: প্রথম আলো, ১২/১/২০১০ আমার দেশ)
পৃথিবীর নানান জায়গায় প্রতিবেশী দেশে দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে, ভারতের সাথেই বৈরি দেশ পাকিস্থান, চীন, নেপাল ও ভূটানের সীমানা রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশী মানুষ হত্যা ইসরাইল-ফিলিস্তিন নয় তা করা হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমানায়। ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বি.এস.এফ এর গুলিতে মারা যায় ৩১৫জন বাংলাদেশী (সূত্রঃ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ)। মেয়েটিকে হত্যার পরদিন আরো ২জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার পর লাশ নিয়ে গেছে বি.এস.এফ (সূত্র: পত্রিকা)!!
সংক্ষেপে একটু খবর! বেশি ব্যখ্যা করে রগরগে করতে চাইনা শুধু জানাতে চাই, বাংলাদেশ সরকারের ৭% জিডিপির অর্থনীতির জন্য আড়িয়াল বিলে ৬ হাজার কোটি টাকার আধুনিক বিমান বন্দর প্রয়োজন নাকি সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করে বাংলাদেশী জনগণকে কাঁটাতারে ঝুলন্ত মৃত্যুর জন্য ভারতে কাজ করতে পাঠানো বন্ধ করা ও দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো প্রয়োজন?
কানাডা ও অপর দেশে যেভাবে বি.এস.এফ কর্মকর্তাদের ভিসা নাকচ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে, যদিও তাদের একজন নাগরিকও বি.এস.এফ এর গুলিতে মারা যায়নি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যখন বি.এ.এফ-কে “ট্রিগার হ্যাপি” আখ্যা দেয় তখন বাংলাদেশের সরকার কি এ রকম ধারাবাহিক হত্যার নিন্দা জানাবে? এই সমস্যা সামাধানে দারিদ্রতা মোকাবেলায় কোন পদক্ষেপ নিবে?
দেশের সচেতন ও বুদ্ধিজিবিগণ কি এ রকম মৃত্যুর দায় কাঁধে নিয়ে সামাধানের লক্ষে কলম ও মেধা ব্যয়ের কষ্টসাধ্য কাজটুকু করবে? ভারতের সরকার বা নুন্যতম পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবিরা কি কিছু বলবে?
মানুষের যে কয়টি অধিকার লঙ্ঘন হতে পারে তার সবকটি লঙ্ঘিত হয়নি এক কিশোরী ফেলানীর মৃত্যুতে? সবশেষে বিশ্বের উদিয়মান মহাশক্তিধর, পারমানবিক বোমার অধিকারী, বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতের সাথে সুসম্পর্ক কামনা করি এবং কিছুটা সম্মান নাই হোক, মানুষ ও বাঙ্গালি হিসেবে আমাদের গুলি করে হত্যা করার আহবান করি, সরকার হয়ত করবে না জেনেই নিজেরা করছি।
ফেলানির বাবা কথা দিয়েছে “পেটের ক্ষুধায়ও আগামীতে আর ভারতে যাবে না”।
সে না যাক। কিন্তু সীমান্তের ওপার এপারের ঘুষ খোরদের পেট ভর্তি করার জন্য আরো কত্ত অভাগা ফেলানীর বাবা-মা, ভাই-বোন যে ভারতে পাড়ি দিবে তাদের ভাগ্যে কি হবে? ঢাকা-দিল্লির গোপন চুক্তিতে কি এর কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে? মদ, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল পাচারকারীরা নিরাপদে পার হয় কোন অদৃশ্য খুটির জোর??!!
লেখক: গবেষক,বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর।